বর্তমান সরকারের ‘বিব্রতকর' - ৫ আপদ
++ ২০১০ সালে শেয়ার বাজারে লোপাট হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সর্বস্ব হারিয়েছে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী।
++ দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল।
++ হলমার্ক গ্রুপের মাধ্যমে ২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা সোনালী ব্যাংক থেকে আত্মসাত্ করা হয়।
++ রেল মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ নিয়ে বস্তা ভরা টাকা উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাবেক রেলমন্ত্রী এখনো 'দপ্তরবিহীন'।
++ সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১১শ'র বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শেষ পর্যন্ত অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা বা জিএসপি স্থগিত হয়ে যায়।
আর কয়েক মাস গেলেই পূর্ণ হবে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ। সরকারের চলতি মেয়াদে ইতিমধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যা জাতীয়ভাবে এবং কখনও কখনও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন বেশ কিছু ঘটনা বর্তমান সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিল, হলমার্ক ও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জালিয়াতি করে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাত্ এবং সর্বশেষ সাভারের রানা প্লাজায় ধস ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক জিএসপি সুবিধা স্থগিতের ঘটনা সরকারকে বিব্রত করতে যথেষ্ট বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংখ্যাও আগের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আগের ঘটনার মূল হোতাদের মতো এবারের হোতারাও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন, এবারের ঘটনায় মূলহোতারা অনেক 'ক্ষমতাধর'।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের লিখিত অভিযোগ সত্ত্বেও পদ্মা সেতু প্রকল্পে মূল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ পায়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ও আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও এই মেয়াদে আর পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।
শেয়ারবাজার:
১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় ২০০ কোটি টাকার মত লোপাট হলেও ২০১০ সালে হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সর্বস্ব হারিয়েছে প্রায় ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী। নেপথ্য নায়করা রয়ে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে 'ক্যাসিনোর' সাথেও তুলনা করেছেন বিশিষ্টজনেরা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন, সাক্ষীর অভাব, তথ্য-প্রমাণাদির অপর্যাপ্ততা ও বিচারিক আদালতে মামলার আধিক্যের কারণে ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজারের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। শেয়ারবাজারে সর্বস্ব খুঁইয়ে একাধিক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। গত কয়েক বছরে শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নানা ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে এর কোন ফলই পাওয়া যায়নি। অনেক উদ্যোগ নিয়েও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর শেয়ারবাজারের (ডিএসই) সূচক (ডিজিইএন) ৮ হাজার ৯০০ অতিক্রম করার পর পতন শুরু হয়। মাত্র দশ কার্য দিবসের মাথায় সূচক পড়ে যায় হাজার পয়েন্টেরও বেশি। বড় দরপতনে একাধিকবার শেয়ারবাজারের লেনদেন স্থগিত করে রাখতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ পতন থামানো যায়নি। ২০১৩ সালের ৩ মার্চ সূচকের পরিমাণ নেমে আসে ৩ হাজারের নিচে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৩১ জুলাই ঢাকার শেয়ারবাজারের সূচক ছিল ৪ হাজার ৩৪২ পয়েন্টে। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেয়ারবাজারের দুই বার ধসের ঘটনা আওয়ামী লীগের আমলে হবার কারণে বিষয়টি নিয়ে সরকারের সকল পর্যায়েই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।
পদ্মা সেতু:
দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল বর্তমান সরকারের মেয়াদে বহুল আলোচিত ঘটনা। বিশ্বব্যাংকের দাবি অনুযায়ী, দুর্নীতির অভিযোগে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর এবং ২০১২ সালের এপ্রিলে মোট দুইবার বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছিলো সংস্থাটি। কিন্তু সরকার মন্ত্রিসভায় রদবদল করলেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঋণ চুক্তি বাতিল না করে পর্যাপ্ত সময় দিয়েছিলো বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সরকার তা করেনি। পরবর্তী সময়ে গত বছরের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করলে সরকারের টনক নড়ে। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ রয়েছে বলে দাবিও করে বিশ্বব্যাংক। তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন সমঝোতায় বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তিতে ফিরে আসার ঘোষণা দেয়। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বর ১৭ তারিখে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত শেষ করে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে অন্য সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে। এর পর বিশ্বব্যাংকের সাথে সরকারের দূরত্ব আরো বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবার আগেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শংকা প্রকাশ করেছেন যে, চলতি মেয়াদে মূল কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না।
হায় হায় কোম্পানি:
সরকারের চলতি মেয়াদে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০০২ সালে পাঁচটি ব্যাংক থেকে ওম প্রকাশ নামের এক ভারতীয় ব্যবসায়ী কারচুপি করে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলো। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের নুরুন্নবী নামক এক ব্যবসায়ীর জাল করা স্থানীয় এলসি দিয়ে ৬২২ কোটি টাকা গায়েব করে দেয়ার ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ২০১২ সালে ডেসটিনি গ্রুপের অপকর্মকে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক 'হায় হায় কোম্পানি' উপাধি দেয়। এর পরেই প্রকাশ পায় সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় (সাবেক শেরাটন শাখা) জালিয়াতির তথ্য। সোনালী ব্যাংকের ব্যর্থতাতেই হোক বা যোগসাজশেই হোক, হলমার্ক নামীয় অখ্যাত একটি গ্রুপের মাধ্যমে ২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকাসহ রূপসী বাংলা শাখা থেকে জালিয়াতি করে মোট ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাত্ করা হয়। হলমার্ক ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক না কোন এর কর্ণধার তানভির মাহমুদের নাম জেনেছে সাধারণ মানুষ। কাগজে-কলমে ৮০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও কোম্পানির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম গ্রেফতারও হয়েছেন। ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর তানভীর মাহমুদ, জেসমিন ইসলামসহ মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ ও সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ও ডিজিএম একেএম আজিজুর রহমানকে আসামি করে ২৭ জনের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন। ৭ অক্টোবর গ্রেফতার হন তানভীর।
জিএসপি স্থগিত:
চলতি বছরের ২৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শেষ পর্যন্ত অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা বা জিএসপি স্থগিত হয়ে গেলো। গত ২৪ নভেম্বর সাভারের তাজরিন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১২ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১১শ'র বেশি প্রাণ ঝরে যায়। দেশের ইতিহাসে ভবন ধসের মতো দুর্ঘটনায় এত বিপুলসংখ্যক লোকের প্রাণহানির ঘটনা আর ঘটেনি। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যত্ নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় 'ভবন ধসে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত্ অন্ধকারে' শিরোনামে এক নিবন্ধ ছাপা হয়।
তবে জিএসপি স্থগিতের ঘটনাকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে উল্লেখ করেছেন গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ। বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতারা একে কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলেও বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু নিরাপদ কর্ম পরিবেশের অজুহাত নয়, শ্রমিক নেতা বাবুল, আমিনুল হত্যাকাণ্ডের বিষয় ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বর্তমান সরকারের টানাপোড়েনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরকারের সম্পর্কের অবনতি হয়।
দুর্নীতি:
দেশে দুর্নীতির বিষয়গুলো এখন আর নতুন কোন বিষয় নয়। দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এগোলো না পেছালো সেটি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) আর সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো। একাধিক মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে দেশের দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এ সরকারের মেয়াদে রেল মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ নিয়ে ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল মধ্যরাতে বস্তাভরা টাকা উদ্ধার এবং এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হওয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ১৫ এপ্রিল পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে সরকারের জন্য বিব্রতকর বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সেই ঘটনার জেরে সাবেক রেলমন্ত্রী এখনও পর্যন্ত 'দপ্তরবিহীন' অবস্থায় রয়েছেন।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে টিআইবি। চলতি বছরের ২১ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটির হিসেবে প্রত্যেক ঠিকাদারকে ৮ দশমিক ৫ থেকে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ কমিশন দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
সৌজন্যে - আলাউদ্দিন চৌধুরী, দৈনিক ইত্তেফাক।
0 comments:
Post a Comment