মাছ দুধ ফলসহ কোথা্য় নেই ফরমালিন!
মাছ, দুধ, ফলসহ, শিশুখাদ্য কি নিরাপদ। আমরা সাধারন মানুষ যাবো কোথায়, খাবো কি ? খাবার মানে, বিষ আর বিষ। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতকে অনুকরন করে বলা যায় - “ না খেলে বাঁচবেন ৭ দিন, আর খেলে বাঁচবেন 3/5 দিন।” অসাধু ব্যবসায়িরা সকল ধরনের খাদ্য পন্যে ফরমালিন সহ মারাত্বক বিষাক্ত রাসায়নিক মিশাচ্ছে।সম্প্রতি এক গবেষণায় ফরমালিনকে কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়সিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ফরমালিন খাদ্যে ব্যবহারের অভিযোগ বহুদিন। ক্ষণে ক্ষণে নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই খাদ্যে এ বিষের ব্যবহার কমছে না। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা রাজধানীর বিভিন্ন বাজার থেকে খাদ্য ও পণ্য নিয়ে গবেষণা করে ব্যাপকহারে ফরমালিন মেশানোর প্রমাণ পেয়েছে।
জানা গেছে, এক সময় শুধু কাঁচা মাছে ফরমালিনের ব্যবহার করা হলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা এখন অধিক মুনাফার আশায় ক্ষতিকর জেনেও শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে ফল, শাকসবজি, মাংস, দুধ, মিষ্টিজাতীয় খাবার, প্যাকেটজাত খাবার, পানীয় এমনকি ইফতারিতেও এ রাসায়নিক ব্যবহার করছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লাইসেন্সপ্রাপ্তদের ফরমালিন ব্যবহারের কথা থাকলেও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে মিটফোর্ডসহ নগরীর অন্য রাসায়নিক দোকান থেকে খুচরা বিক্রেতাদের হাত হয়ে ফরমালিন এখন পুরো দেশেই সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা ফরমালিনের এ অবাধ ব্যবহার রোধে খুচরা বাজারে ফরমালিন বিক্রি বন্ধের ওপর জোর দিয়েছেন। মাছ : কয়েক বছর ধরেই দীর্ঘ সময় ধরে মাছ সংরক্ষণের জন্য বিক্রেতারা কাঁচা মাছে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর পদার্থ ফরমালিন ব্যবহার করছেন। মাছ দুধ ফল কীসে নেই ফরমালিন!
এক্ষেত্রে বিক্রেতাদের দাবি বিদেশ আমদানি করা মাছগুলোতেই ফরমালিনের ব্যবহার হচ্ছে। আজ থেকে ৫-৬ বছর আগ ২০০৫ ও ২০০৬ সালেও রাজধানীর মাছের বাজারে বড় মাছগুলোর পাশাপাশি ছোট মাছগুলোতেও পরীক্ষায় ফরমালিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ফলে এটি পরীক্ষিত যে বিদেশি আমদানিকৃত বড় মাছের পাশাপাশি ছোট দেশি মাছেও ফরমালিন ব্যবহৃত হচ্ছে। ফরমালিনের অপব্যবহার রোধে সে সময় ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা মোবাইল কোর্টে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে ফরমালিনযুক্ত মাছ ব্যাপকহারে ধরে অভিযুক্তদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। আইনশৃক্সখলা বাহিনীকে ফাঁকি দিতে বর্তমানে মাছের পাশাপাশি বরফেও ফরমালিন ব্যবহার হচ্ছে। ফল : আম, কলা, খেজুর, পেঁপে আনারস, মালটা, আপেল, আঙ্গুর এসব ফলে ফরমালিন ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্প্রতি পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফলে ফরমালিন মেশানোর ভয়ঙ্কর তথ্য। চলতি বছরে জুন মাসে পবা ঢাকার মৌসুমি ফলে ফরমালিনের অবস্থা পরীক্ষার জন্য ১০ দিনব্যাপী এক কর্মসূচি চালায়। এতে ঢাকার ২৯টি এলাকা থেকে সংগৃহীত ফলের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ৮২ শতাংশ আম, ৯১ শতাংশ কলা, ১০০ শতাংশ মালটা, ৫৯ শতাংশ আপেল, ৯৫ শতাংশ আঙ্গুর, ৭৭ শতাংশ খেজুর এ ফরমালিনের উপস্থিতি পায়। দুধেও ফরমালিন : এখন দুধে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। দীর্ঘ সময় পরও দুধ যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য দুধে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর পদার্থটি। অসাধু ব্যবসায়ীরা দুধ যাতে নষ্ট না হয় সে কারণে এতে ঘনমাত্রার ফরমালিন মেশাচ্ছেন। গত ২৫ জুলাই রাজধানীর নবাবপুরের রথখোলা মোড়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ফরমালিনযুক্ত ৩০০ লিটার তরল দুধ নষ্ট করা হয়। এ ছাড়া গতকাল একই স্থান থেকে র্যাব-১০ এর অভিযানে ১২০০ লিটার ফরমালিনযুক্ত তরল দুধ নষ্ট করা হয়। এ ছাড়াও প্যাকেটজাত খাবার যেমন ফলের রস, স্ন্যাক ফুড, জ্যাম-জেলি-ক্রিম, আচার-চাটনিতেও ফরমালিন ব্যবহার হচ্ছে বলে পবা জানায়। ফরমালিন যে কাজে ব্যবহৃত হয় : রাসায়নিক পদার্থ ফরমালিন সাধারণত মরদেহ বা প্রাণীদেহের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়াও কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, ট্যানারি শিল্প ও প্লাস্টিক কারখানায় ফরমালিন ব্যবহৃত হয়। সাধারণত লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা ফরমালিন বিদেশ থেকে আমদানি করেন। পরে তাদের হাত হয়ে রাসায়নিকটি খোলাবাজারে চলে যায়। আন্তর্জাতিকভাবে খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ। সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে নেই পরীক্ষা যন্ত্র : এই যখন অবস্থা তখন দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর নিজস্ব ফরমালিন পরীক্ষাগার নেই বলে পবার প্রতিবেদনে ওঠে আসে। জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন, খাদ্য অধিদফতর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ফরমালিন পরীক্ষার কোনো যন্ত্র নেই। ফরমালিন শনাক্তের সহজ পদ্ধতি : মাছে ফরমালিন দেওয়া আছে কিনা তা ক্রেতারা একটু সতর্ক হলেই বুঝতে পারবেন। সাধারণত ফরমালিন দেওয়া মাছের গায়ে পিচ্ছিলভাব থাকবে না। মাছের গা খসখসে হবে, চোখের মনি উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ না হয়ে ঘোলা আর মলিন দেখাবে, মাছের কান লালের বদলে হালকা বাদামি দেখাবে। রান্নার পর মাছের স্বাভাবিক স্বাদ পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে মাথা ও পেটের অংশ অত্যন্ত বিস্বাদ ও রাসায়নিক গন্ধযুক্ত হবে। ফরমালিন দেওয়া দুধের তৈরি মিষ্টি বা দধিতে স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যাবে না। ফরমালিন দেওয়া ফলে বিশেষ করে আম, আঙ্গুর, নাশপাতি মিষ্টি সুগন্ধ পাওয়া যাবে না এতে মাছি ও অন্য কীটপ্রত্যঙ্গ বসবে না। ফল সহজে পচবে না। এ ছাড়া কোনো মাছ বা ফলের দোকানে গিয়ে ঝাঁজ ভাব লাগবে বুঝে নিতে হবে যে সেখানের পণ্যে ফরমালিন ব্যবহৃত হয়েছে। ফরমালিনযুক্ত খাবারের কুফল : চিকিৎসকরা জানান, নিয়মিত ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া ফরমালিন খেলে খাদ্যে পরিপাক বাধাগ্রস্ত, চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করে, পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্ত, লিভারের এনজাইম নষ্ট এবং কিডনির কোষ নেফ্রন ধ্বংস হয়। এতে গ্যাস্ট্রিক আলসার বাড়ে, লিভার ও কিডনির নানা রকম জটিল রোগ দেখা দেয়। মেয়েদের ঋতুস্রাবে সমস্যা ও গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, খোলাবাজারে ফরমালিন বিক্রি বন্ধ করার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে খুচরা আকারে ফরমালিনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। যেহেতু ফরমালিন লাইসেন্স ব্যবহার করে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় সে জন্য সরকারের উচিত যে নিদিষ্ট পরিমাণ ফরমালিন আমদানি করা হয় তার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা এর তদারকি করা।
সূত্ত্র: ফারহান সুজন : দৈনিক আমাদের সময়
0 comments:
Post a Comment