ঝাঁকে ঝাঁকে জালে টনে টনে পাচারইলিশের স্বাদ নিচ্ছে ভারত, বঞ্চিত দেশ
ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। নদী-সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রসনার ইলিশ। বড় ইলিশের দেখা সাধারণত বছরের অন্য সময় পাওয়া যায় না। গত কয়েক দিনে জালে ধরা দিচ্ছে বড় ইলিশও। কিন্তু অতিরিক্ত দামের কারণে গড়পড়তা আয়ের পরিবার বড় ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর আকাশছোঁয়া এই দামের নেপথ্যে রয়েছে পাচার। বড় ইলিশ চলে যাচ্ছে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাশের দেশ ভারতে। এ অবস্থায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে উঠছে মাঝারি আকারের ইলিশ।
দেশবাসীর পাতে ইলিশের টুকরো তুলে দিতে গত বছর রমজান মাসে ভারতে ইলিশ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে সরকার। এর সুফলও মিলেছিল। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। চোরাচালানিদের দৌরাত্ম্যে ইলিশের রসনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের মানুষ।
সীমান্তে ইলিশ চোরাচালানের জমজমাট ব্যবসা চলছে। সড়কপথে দুই-তিনটি রুটে আর নদীপথে ইলিশ পাচার হয়ে যাচ্ছে কলকাতায়। ইলিশ পাচার এতই জমজমাট যে যশোরের বেনাপোল সীমান্তবর্তী সাদিপুর গ্রামটি পরিচিত হয়ে পড়েছে 'সাদিপুর ঘাট' নামে। গত ৭ মাসে বিজিবি ওই সীমান্ত দিয়ে পাচারকালে ছয় হাজার ১৩০ কেজি ইলিশ আটক করেছে। সাতক্ষীরার সীমান্ত দিয়েও একইভাবে মণকে মণ ইলিশ পাচার হচ্ছে। এভাবে অবাধ পাচারের কারণে একদিকে দেশবাসী বড় ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে ভারতে বৈধভাবে রপ্তানি হলে যে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যেত তাও হারাচ্ছে দেশ।
জানা গেছে, গত বছর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শে ভারতে ইলিশ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে সরকার। পরে রপ্তানিকারকদের চাপে এফবিসিসিআই রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সুপারিশ করলেও সরকার তাতে কান দেয়নি। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইচ্ছায় ইলিশ রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। ভারতের প্রভাবশালী আনন্দবাজার পত্রিকা সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছে, 'পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে বাগড়া দেওয়ায় বাংলাদেশের সরকার ইলিশ রপ্তানিতে আগ্রহী নয়।'
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন শিকদার বলেন, এক কেজি বা তার কাছাকাছি ওজনের ইলিশ দেশের বাজারে খুব বেশি আসছে না। ভারতে চলে যাচ্ছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে ইলিশ পাচার হচ্ছে। আবার নৌপথে সাতক্ষীরা থেকে ভারতের কাকদ্বীপসহ কয়েকটি পথে ইলিশ চলে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশে। ইলিশ পাচারে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রশ্রয় আছে দাবি করে তিনি বলেন, ভারত থেকে গরু এলেই বিএসএফ গুলি করে। কিন্তু ইলিশ পাচার করতে গিয়ে কেউ গুলি খেয়েছে এমনটা শোনা যায় না।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে অবাধে ইলিশ পাচার : চোরাকারবারিরা ইলিশ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে যশোরের সাদিপুর, পুটখালী, গাতিপাড়া, সাতক্ষীরার কলারোয়া ও ভোমরা সীমান্তকে ব্যবহার করছে। বিজিবি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে দাবি করলেও ইলিশ পাচার বন্ধ হয়নি।
সরেজমিনে জানা যায়, বরিশাল ও পটুয়াখালী থেকে ট্রাক-পিকআপে যশোরের মাছের বাজারে ইলিশ আসে। চোরাচালানিরা তা নিয়ে যায় বেনাপোলে। সেখান থেকে কার্টন ভর্তি করে ইলিশ নিয়ে যাওয়া হয় বেনাপোল চেকপোস্টের সীমান্তবর্তী সাদিপুর গ্রামে। অবাধ চোরাচালানের কারণে গ্রামটি সাদিপুর ঘাট হিসেবে পরিচিত। ছোট একটি খালের বেড়ি পার হলেই ভারতের জয়ন্তীপুর। ২০-৩০ জনের চোরাচালানি দল প্রতি কার্টনে ৩০ থেকে ৪০ কেজি ইলিশ মাথায় করে ভারতের চোরাচালানি মহাজনদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শরিফুল, হাফিজুল ও শফিউর নামের তিন ব্যক্তি সিন্ডিকেট করে সাদিপুর ঘাট দিয়ে ওপারে ইলিশ পাচার করে। বিশেষ বিশেষ কারণে সাদিপুর ঘাট বন্ধ থাকলে চোরাচালানিরা তখন গাতিপাড়া ঘাটকে বেছে নেয়। এই ঘাটে ইলিশ পাচারের সঙ্গে জড়িত জসিম সিন্ডিকেট। জসিমের নেতৃত্বে ইছামতি নদী পার করে চোরাচালানিরা ভারতের কালিনীতে ইলিশ নিয়ে যায়।
ইলিশ পাচারের আরেকটি বড় রুট বেনাপোলের সীমান্তবর্তী পুটখালী ঘাট। এই ঘাটের জিয়া সিন্ডিকেট মণ মণ ইলিশ পাচার করছে। জানা যায়, চোরাচালানিরা পুটখালী ঘাট পার করে ভারতের আংরাইলে ঘাট মালিক কানাইয়ের কাছে ইলিশ পৌঁছে দেয়। এ ছাড়া চোরাচালানিরা ট্রাক ও পিকআপযোগে বড় বড় ইলিশের চালান সাতক্ষীরার কলারোয়া ও ভোমরার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পাচার করে। পরবর্তী সময়ে পাচারকৃত ওই সব ইলিশ হাতবদলের মাধ্যমে বনগাঁও, মসলেন্দপুর, বারাসাত, কলকাতার শিয়ালদহ ও হাওড়ার পাইকারি মাছ বাজারে পৌঁছে যায়।
দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ইলিশ পাচারের সময় ঘাট এলাকা থেকে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা কার্টনপ্রতি বিজিবির নামে এক হাজার টাকা ও পুলিশের নামে ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে। এ ব্যাপারে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রবিউল ইবনে কামরুল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিনিয়ত ইলিশ পাচার হচ্ছে। এই পাচার বন্ধে বিওপিগুলোকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত সাত মাসে আমরা ছয় হাজার ১০০ কেজি ইলিশ জব্দ করেছি। ইলিশ পাচার রোধে আরো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।'
সাতক্ষীরায় ইলিশ পাচার মৌসুমী ব্যবসা : ইলিশ পাচারকে কেন্দ্র করে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে এখন মৌসুমী ব্যবসায়ীদের ব্যাপক আনাগোনা। জেলার চরাবাড়ি সীমান্তের ইলিশ পাচারকারী আবদুল ওয়াহেদ জানান, তাঁরা সাতক্ষীরার হাটা বর্ডার (ভূমির ওপর দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেশ বিভক্ত করা) দিয়ে সবচেয়ে বেশি মাছ পাচার করেন। তিনিসহ ভোমরা সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের অনেকে মৌসুমী ব্যবসা হিসেবে ইলিশ পাচার করে থাকেন। প্রতিবছর ইলিশের ভরা মৌসুমে (তিন-চার মাস) তাঁরা স্থানীয় বাজার থেকে কিনে ভারতের বশিরহাট, হঠাৎগঞ্জ, তারালীসহ আশপাশের বাজারে পাইকারি বিক্রি করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন মাছ বাজারের মাড়োয়ারিরা এ দেশের মাছের আড়ৎদারদের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আগাম পাঠিয়ে দেন। পরে তাঁদের চাহিদামতো ইলিশ সীমান্তের চোরাচালান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সীমান্ত পার করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ভারতের ব্যবসায়ীরা তাঁদের নির্ধারিত আড়তে নিয়ে যান।
ভোমরা সীমান্তের ইলিশ পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্য ভোমরা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম, মাহমুদপুর গ্রামের কানা সালাম, মোটা নজরুল ও টুটুল জানান, তাঁরা সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে মাঝেমধ্যে ভারতে ইলিশ পার করে দেন। ভোলা, বরিশাল, মংলা ও খুলনা মৎস্য আড়তের ব্যবসায়ীরা সীমান্তে ইলিশ এনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রমিক দিয়ে রাতের বেলা মাছ ওপারে (ভারতে) দিয়ে আসেন।
ভোমরা বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার গুলজার আহম্মেদ ইলিশ পাচারের সত্যতা স্বীকার করে জানান, ভারতে পাচারকালে সম্প্রতি একটি পিকআপ ভর্তি ইলিশ ও দুটি মোটরসাইকেল আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া গত দুই মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ইলিশ পাচারকালে আটক করা হয়েছে।
জেলের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, রাত ফুরালেই উধাও : কয়েক দিন ধরে গভীর বঙ্গোপসাগরসহ উপকূলজুড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। মাছ ধরার একেকটি ট্রলার গড়ে তিন থেকে চার হাজার ইলিশ নিয়ে সাগর থেকে কূলে ফিরছে। কয়েক দিন আগে বরগুনার নিশানবাড়িয়া গ্রামের সত্তার মাস্টারের একটি ট্রলার ১২ হাজার ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফেরে। যার অধিকাংশ ছিল এক কেজির কাছাকাছি ওজনের।
পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ ও পাইকারি বাজার কেন্দ্রের পাইকার সমিতির সভাপতি সাফায়েত হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় থেকে দুই হাজার মণ ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এই বাজারে। এর সবই ট্রাক বোঝাই হয়ে চলে যাচ্ছে যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক পাইকার জানান, এখান থেকে সারা দেশে যে ইলিশ যায় তার অর্ধেকই চোরাই পথে চলে যায় ভারতে।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লে. কর্নেল সোলায়মান শেখ জানান, গত মাসের তুলনায় অনেক বেশি ইলিশ পড়ছে এ মাসে। সারা জুলাই মাসে পাথরঘাটার মৎস্য বন্দরে মোট ইলিশের অবতরণ ছিল দুই লাখ ৩১ হাজার ৫৪২ কেজি। চলতি মাসে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আগস্ট মাসের প্রথম ১২ দিনে এখানে মোট অবতরণ হয়েছে দুই লাখ দুই হাজার ২৮৭ কেজি ইলিশ।
যাচ্ছে ইলিশ, আসছে পণ্য : পটুয়াখালীর জেলেরা জানান, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সংঘবদ্ধ একটি চক্র নদী থেকেই জোর করে ইলিশ কিনে ভারত ও মিয়ানমারে পাচার করছে। নতুন কৌশল হিসেবে পাচারকারীরা শাড়ি, থ্রি-পিস, জুতা ও নেশাজাতীয় পানীয়র বিনিময়ে ইলিশ নিয়ে নিচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়া চলছে অরক্ষিত বঙ্গোপসাগরে বিদেশি জেলে ও চোরাচালানিদের অবাধ বিচরণের কারণে।
জানা গেছে, অনেক ট্রলারমালিক উপকূলীয় সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার টন ইলিশ বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। সাগর থেকে ভারতীয় কিংবা মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে খালি ট্রলার ফিরছে ঘাটে। আবার বড় মাছ বিক্রি করে অনেক ট্রলার ছোট ইলিশ নিয়ে আসছে।
পাথরঘাটা উপজেলার ঘুটাবাসা গ্রামের রুস্তম মাঝি জানান, বাংলাদেশিরা রাতে সুন্দরবন এলাকার বিভিন্ন নদী কিংবা খাল ও ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত রায়মঙ্গল, হাঁড়িয়াভাঙ্গা এবং কালিন্দী নদী এলাকা দিয়ে ভারতীয় ট্রলারে তুলে দিচ্ছে ইলিশ। বিনিময়ে তাঁদের কাছ থেকে সমমূল্যের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে আসছে বাংলাদেশের বাজারে।
বিষয়টি সম্পর্কে কলাপাড়া মৎস্য বন্দর আলীপুর ও মহিপুর আড়ৎদার সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, 'অনেক জেলে শূন্য ট্রলার নিয়ে সাগর থেকে উপকূলে ফিরছে। সাগরে তাঁরা ভারতীয় ট্রলারে মাছ বিক্রি করছে কি না সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তবে ভারতীয়রা বাংলাদেশি জলসীমায় ঢুকে সাগর দখল করে ইলিশের আনাগোনার স্থানে জাল ফেলে ইলিশ শিকার করে। ইলিশ শিকারে এরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রূপালী ইলিশ ভারতে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জেলেরা মৎস্য কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। বংলাদেশের জলসীমায় বিদেশি জেলেদের প্রবেশ বন্ধ করা না গেলে বিদেশিদের ইলিশ শিকার কিংবা পাচার কখনোই বন্ধ হবে না।'
এ ব্যাপারে কোস্টগার্ড ভোলা জোনের লে. কমান্ডার মাজহার বলেন, 'সীমিত সম্পদ এবং কম জনবল দিয়ে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছি। ইলিশ পাচার হয় এমন নির্ধারিত এলাকা কিংবা পাচারকারীদের সম্পর্কে কেউ আমাদের অবহিত করলে অবশ্যই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।'
প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্যের জোগান দিয়েছেন কালের কণ্ঠের যশোরের নিজস্ব প্রতিবেদক ফখরে আলম, বরগুনা প্রতিনিধি সোহেল হাফিজ, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি মোশাররফ হোসেন ও পটুয়াখালী প্রতিনিধি এমরান হাসান সোহেল।
দেশবাসীর পাতে ইলিশের টুকরো তুলে দিতে গত বছর রমজান মাসে ভারতে ইলিশ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে সরকার। এর সুফলও মিলেছিল। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। চোরাচালানিদের দৌরাত্ম্যে ইলিশের রসনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের মানুষ।
সীমান্তে ইলিশ চোরাচালানের জমজমাট ব্যবসা চলছে। সড়কপথে দুই-তিনটি রুটে আর নদীপথে ইলিশ পাচার হয়ে যাচ্ছে কলকাতায়। ইলিশ পাচার এতই জমজমাট যে যশোরের বেনাপোল সীমান্তবর্তী সাদিপুর গ্রামটি পরিচিত হয়ে পড়েছে 'সাদিপুর ঘাট' নামে। গত ৭ মাসে বিজিবি ওই সীমান্ত দিয়ে পাচারকালে ছয় হাজার ১৩০ কেজি ইলিশ আটক করেছে। সাতক্ষীরার সীমান্ত দিয়েও একইভাবে মণকে মণ ইলিশ পাচার হচ্ছে। এভাবে অবাধ পাচারের কারণে একদিকে দেশবাসী বড় ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে ভারতে বৈধভাবে রপ্তানি হলে যে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যেত তাও হারাচ্ছে দেশ।
জানা গেছে, গত বছর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শে ভারতে ইলিশ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে সরকার। পরে রপ্তানিকারকদের চাপে এফবিসিসিআই রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সুপারিশ করলেও সরকার তাতে কান দেয়নি। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইচ্ছায় ইলিশ রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। ভারতের প্রভাবশালী আনন্দবাজার পত্রিকা সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছে, 'পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে বাগড়া দেওয়ায় বাংলাদেশের সরকার ইলিশ রপ্তানিতে আগ্রহী নয়।'
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন শিকদার বলেন, এক কেজি বা তার কাছাকাছি ওজনের ইলিশ দেশের বাজারে খুব বেশি আসছে না। ভারতে চলে যাচ্ছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে ইলিশ পাচার হচ্ছে। আবার নৌপথে সাতক্ষীরা থেকে ভারতের কাকদ্বীপসহ কয়েকটি পথে ইলিশ চলে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশে। ইলিশ পাচারে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রশ্রয় আছে দাবি করে তিনি বলেন, ভারত থেকে গরু এলেই বিএসএফ গুলি করে। কিন্তু ইলিশ পাচার করতে গিয়ে কেউ গুলি খেয়েছে এমনটা শোনা যায় না।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে অবাধে ইলিশ পাচার : চোরাকারবারিরা ইলিশ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে যশোরের সাদিপুর, পুটখালী, গাতিপাড়া, সাতক্ষীরার কলারোয়া ও ভোমরা সীমান্তকে ব্যবহার করছে। বিজিবি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে দাবি করলেও ইলিশ পাচার বন্ধ হয়নি।
সরেজমিনে জানা যায়, বরিশাল ও পটুয়াখালী থেকে ট্রাক-পিকআপে যশোরের মাছের বাজারে ইলিশ আসে। চোরাচালানিরা তা নিয়ে যায় বেনাপোলে। সেখান থেকে কার্টন ভর্তি করে ইলিশ নিয়ে যাওয়া হয় বেনাপোল চেকপোস্টের সীমান্তবর্তী সাদিপুর গ্রামে। অবাধ চোরাচালানের কারণে গ্রামটি সাদিপুর ঘাট হিসেবে পরিচিত। ছোট একটি খালের বেড়ি পার হলেই ভারতের জয়ন্তীপুর। ২০-৩০ জনের চোরাচালানি দল প্রতি কার্টনে ৩০ থেকে ৪০ কেজি ইলিশ মাথায় করে ভারতের চোরাচালানি মহাজনদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শরিফুল, হাফিজুল ও শফিউর নামের তিন ব্যক্তি সিন্ডিকেট করে সাদিপুর ঘাট দিয়ে ওপারে ইলিশ পাচার করে। বিশেষ বিশেষ কারণে সাদিপুর ঘাট বন্ধ থাকলে চোরাচালানিরা তখন গাতিপাড়া ঘাটকে বেছে নেয়। এই ঘাটে ইলিশ পাচারের সঙ্গে জড়িত জসিম সিন্ডিকেট। জসিমের নেতৃত্বে ইছামতি নদী পার করে চোরাচালানিরা ভারতের কালিনীতে ইলিশ নিয়ে যায়।
ইলিশ পাচারের আরেকটি বড় রুট বেনাপোলের সীমান্তবর্তী পুটখালী ঘাট। এই ঘাটের জিয়া সিন্ডিকেট মণ মণ ইলিশ পাচার করছে। জানা যায়, চোরাচালানিরা পুটখালী ঘাট পার করে ভারতের আংরাইলে ঘাট মালিক কানাইয়ের কাছে ইলিশ পৌঁছে দেয়। এ ছাড়া চোরাচালানিরা ট্রাক ও পিকআপযোগে বড় বড় ইলিশের চালান সাতক্ষীরার কলারোয়া ও ভোমরার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পাচার করে। পরবর্তী সময়ে পাচারকৃত ওই সব ইলিশ হাতবদলের মাধ্যমে বনগাঁও, মসলেন্দপুর, বারাসাত, কলকাতার শিয়ালদহ ও হাওড়ার পাইকারি মাছ বাজারে পৌঁছে যায়।
দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ইলিশ পাচারের সময় ঘাট এলাকা থেকে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা কার্টনপ্রতি বিজিবির নামে এক হাজার টাকা ও পুলিশের নামে ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে। এ ব্যাপারে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রবিউল ইবনে কামরুল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিনিয়ত ইলিশ পাচার হচ্ছে। এই পাচার বন্ধে বিওপিগুলোকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত সাত মাসে আমরা ছয় হাজার ১০০ কেজি ইলিশ জব্দ করেছি। ইলিশ পাচার রোধে আরো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।'
সাতক্ষীরায় ইলিশ পাচার মৌসুমী ব্যবসা : ইলিশ পাচারকে কেন্দ্র করে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে এখন মৌসুমী ব্যবসায়ীদের ব্যাপক আনাগোনা। জেলার চরাবাড়ি সীমান্তের ইলিশ পাচারকারী আবদুল ওয়াহেদ জানান, তাঁরা সাতক্ষীরার হাটা বর্ডার (ভূমির ওপর দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেশ বিভক্ত করা) দিয়ে সবচেয়ে বেশি মাছ পাচার করেন। তিনিসহ ভোমরা সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের অনেকে মৌসুমী ব্যবসা হিসেবে ইলিশ পাচার করে থাকেন। প্রতিবছর ইলিশের ভরা মৌসুমে (তিন-চার মাস) তাঁরা স্থানীয় বাজার থেকে কিনে ভারতের বশিরহাট, হঠাৎগঞ্জ, তারালীসহ আশপাশের বাজারে পাইকারি বিক্রি করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন মাছ বাজারের মাড়োয়ারিরা এ দেশের মাছের আড়ৎদারদের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আগাম পাঠিয়ে দেন। পরে তাঁদের চাহিদামতো ইলিশ সীমান্তের চোরাচালান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সীমান্ত পার করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ভারতের ব্যবসায়ীরা তাঁদের নির্ধারিত আড়তে নিয়ে যান।
ভোমরা সীমান্তের ইলিশ পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্য ভোমরা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম, মাহমুদপুর গ্রামের কানা সালাম, মোটা নজরুল ও টুটুল জানান, তাঁরা সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে মাঝেমধ্যে ভারতে ইলিশ পার করে দেন। ভোলা, বরিশাল, মংলা ও খুলনা মৎস্য আড়তের ব্যবসায়ীরা সীমান্তে ইলিশ এনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রমিক দিয়ে রাতের বেলা মাছ ওপারে (ভারতে) দিয়ে আসেন।
ভোমরা বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার গুলজার আহম্মেদ ইলিশ পাচারের সত্যতা স্বীকার করে জানান, ভারতে পাচারকালে সম্প্রতি একটি পিকআপ ভর্তি ইলিশ ও দুটি মোটরসাইকেল আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া গত দুই মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ইলিশ পাচারকালে আটক করা হয়েছে।
জেলের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, রাত ফুরালেই উধাও : কয়েক দিন ধরে গভীর বঙ্গোপসাগরসহ উপকূলজুড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। মাছ ধরার একেকটি ট্রলার গড়ে তিন থেকে চার হাজার ইলিশ নিয়ে সাগর থেকে কূলে ফিরছে। কয়েক দিন আগে বরগুনার নিশানবাড়িয়া গ্রামের সত্তার মাস্টারের একটি ট্রলার ১২ হাজার ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফেরে। যার অধিকাংশ ছিল এক কেজির কাছাকাছি ওজনের।
পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ ও পাইকারি বাজার কেন্দ্রের পাইকার সমিতির সভাপতি সাফায়েত হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় থেকে দুই হাজার মণ ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এই বাজারে। এর সবই ট্রাক বোঝাই হয়ে চলে যাচ্ছে যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক পাইকার জানান, এখান থেকে সারা দেশে যে ইলিশ যায় তার অর্ধেকই চোরাই পথে চলে যায় ভারতে।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লে. কর্নেল সোলায়মান শেখ জানান, গত মাসের তুলনায় অনেক বেশি ইলিশ পড়ছে এ মাসে। সারা জুলাই মাসে পাথরঘাটার মৎস্য বন্দরে মোট ইলিশের অবতরণ ছিল দুই লাখ ৩১ হাজার ৫৪২ কেজি। চলতি মাসে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আগস্ট মাসের প্রথম ১২ দিনে এখানে মোট অবতরণ হয়েছে দুই লাখ দুই হাজার ২৮৭ কেজি ইলিশ।
যাচ্ছে ইলিশ, আসছে পণ্য : পটুয়াখালীর জেলেরা জানান, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সংঘবদ্ধ একটি চক্র নদী থেকেই জোর করে ইলিশ কিনে ভারত ও মিয়ানমারে পাচার করছে। নতুন কৌশল হিসেবে পাচারকারীরা শাড়ি, থ্রি-পিস, জুতা ও নেশাজাতীয় পানীয়র বিনিময়ে ইলিশ নিয়ে নিচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়া চলছে অরক্ষিত বঙ্গোপসাগরে বিদেশি জেলে ও চোরাচালানিদের অবাধ বিচরণের কারণে।
জানা গেছে, অনেক ট্রলারমালিক উপকূলীয় সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার টন ইলিশ বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। সাগর থেকে ভারতীয় কিংবা মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে খালি ট্রলার ফিরছে ঘাটে। আবার বড় মাছ বিক্রি করে অনেক ট্রলার ছোট ইলিশ নিয়ে আসছে।
পাথরঘাটা উপজেলার ঘুটাবাসা গ্রামের রুস্তম মাঝি জানান, বাংলাদেশিরা রাতে সুন্দরবন এলাকার বিভিন্ন নদী কিংবা খাল ও ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত রায়মঙ্গল, হাঁড়িয়াভাঙ্গা এবং কালিন্দী নদী এলাকা দিয়ে ভারতীয় ট্রলারে তুলে দিচ্ছে ইলিশ। বিনিময়ে তাঁদের কাছ থেকে সমমূল্যের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে আসছে বাংলাদেশের বাজারে।
বিষয়টি সম্পর্কে কলাপাড়া মৎস্য বন্দর আলীপুর ও মহিপুর আড়ৎদার সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, 'অনেক জেলে শূন্য ট্রলার নিয়ে সাগর থেকে উপকূলে ফিরছে। সাগরে তাঁরা ভারতীয় ট্রলারে মাছ বিক্রি করছে কি না সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তবে ভারতীয়রা বাংলাদেশি জলসীমায় ঢুকে সাগর দখল করে ইলিশের আনাগোনার স্থানে জাল ফেলে ইলিশ শিকার করে। ইলিশ শিকারে এরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রূপালী ইলিশ ভারতে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জেলেরা মৎস্য কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। বংলাদেশের জলসীমায় বিদেশি জেলেদের প্রবেশ বন্ধ করা না গেলে বিদেশিদের ইলিশ শিকার কিংবা পাচার কখনোই বন্ধ হবে না।'
এ ব্যাপারে কোস্টগার্ড ভোলা জোনের লে. কমান্ডার মাজহার বলেন, 'সীমিত সম্পদ এবং কম জনবল দিয়ে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছি। ইলিশ পাচার হয় এমন নির্ধারিত এলাকা কিংবা পাচারকারীদের সম্পর্কে কেউ আমাদের অবহিত করলে অবশ্যই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।'
প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্যের জোগান দিয়েছেন কালের কণ্ঠের যশোরের নিজস্ব প্রতিবেদক ফখরে আলম, বরগুনা প্রতিনিধি সোহেল হাফিজ, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি মোশাররফ হোসেন ও পটুয়াখালী প্রতিনিধি এমরান হাসান সোহেল।
নাইস
ReplyDelete