Translate

Friday, March 15, 2013

ন্যায়বিচার চাই - ভোক্তার জন্য

ভোক্তার জন্য ন্যায়বিচার চাই

১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডির উদ্যোগে উত্থাপিত চারটি ভোক্তা অধিকার সংবলিত ঐতিহাসিক বিল মার্কিন কংগ্রেস অনুমোদনের ফলে ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের আনুষ্ঠানিক ও আইনানুগ যাত্রা শুরু হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় দেশে দেশে কোটি কোটি ভোক্তা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী কার্যকলাপ প্রতিরোধ করছেন এবং ক্রেতা-ভোক্তাদের সংগঠন গড়ে তুলছেন। ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে হেগে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি দেশের ভোক্তা সংগঠনের আয়োজিত সভায় ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব কনজুমারস ইউনিয়ন (আইওসিইউ) গঠিত হয়েছিল। পরে এর নাম হয় কনজুমারস ইন্টারন্যাশনাল (সিআই)। ১৯৮৩ সাল থেকে সিআই-এর আহ্বানে প্রতি বছর ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্যÑ ‘এখনই ভোক্তার জন্য ন্যায়বিচার চাই’।


আমাদের দেশে সত্তরের দশকে ভোক্তা আন্দোলন শুরু করার চার দশক পর ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন পাস হয়। এ আইনে ২০ ধরনের অপরাধের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ৫৪ ধারায় মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করার দণ্ড : কোনো ব্যক্তি, কোনো ব্যবসায়ী বা সেবা প্রদানকারীকে হয়রানি বা জনসমক্ষে হেয় বা বা ব্যবসায়িক ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করলে ওই ব্যক্তি অনূর্ধ্ব তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৫০ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন করলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
একজন নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদক ও বাজারজাতকারী জঘন্য সন্ত্রাসীর চেয়েও মারাত্মক। অনেক লোকের প্রাণহানি নীরবে ঘটিয়ে শাস্তি পাবেন তিন বছর জেল ও দুই লাখ টাকা জরিমানা। আর একজন সাধারণ ভোক্তা কারো অপব্যবসায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তা প্রমাণে ব্যর্থ হলে ব্যবসায়ীর মামলায় নিজেই শাস্তি ভোগ করবেন তিন বছর জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। এটা কি ন্যায়বিচার? কোর্ট-কাচারিতে একটি অভিযোগ দায়ের করে তা প্রমাণ করা সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টকর। এ জন্য যে মানের আইনজীবী প্রয়োজন তা সাধারণ ভোক্তার নাগালের বাইরে। ফলে আইনগত বাধ্যবাধকতার ভয়ে ভোক্তা পণ্য কিনে ঠকলে ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের না করাই শ্রেয় মনে করেন। অর্থাৎ, ভোক্তা আইনে সাধারণ মানুষের অভিযোগ দায়ের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচ) অধীনস্থ ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, দেশের মানুষ প্রতিদিন যে মাছ, গোশত, দুধ, ফল, চাল, ডাল, তেল, মসলা ও লবণ খাচ্ছে এর শতকরা ৪০-৫৪ ভাগই ভেজাল। এসব খাদ্যে বিভিন্ন কীটনাশক, ভারী ধাতু, সিসা, আর্সেনিক ও স্টেফাইলোকক্কাসের মতো ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।
ফল পাকাতে ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ইথেফেন এবং সতেজ রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। চিকিৎসা ও পুষ্টিবিদেরা বলেন, এগুলোর প্রভাবে শিশুর ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনি ও লিভার পচে যাওয়া, রক্ত সরবরাহ বিঘিœত হওয়া, এমনকি অন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, ইথেফেনের কারণে ২০-৩০ শতাংশ এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইডের কারণে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায় ফলের পুষ্টিমান। জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালে পাঁচ হাজার ৭৫৯টি খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করে ভেজাল পেয়েছিল দুই হাজার ৯৯০টিতে। গত জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠানটি ৩৭৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৮৭টি ভেজাল পায়। ডিম ও মাছ উৎপাদনে ট্যানারির বর্জ্যজাত খাদ্য ব্যবহার করে মানবস্বাস্থ্য বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। লবণ ও মুড়ি সাদা করতে হাইড্রোজ ও ইউরিয়ার অপব্যবহার চলছে। ইরি-২৮ চাল অটোরাইস মিলে কেটেছেঁটে নাজির শাইল ও মিনিকেট বানানোর বাহারি কৌশলের ফাঁদে দেশের মানুষ। তদুপরি, অতিরিক্ত দাম দিয়ে এসব পণ্য কিনতে হচ্ছে।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অভিযোগে ৬২টি কোম্পানির তৈরী ওষুধ পরীক্ষার জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর কাজ করছে। কমিটির সভায় নি¤œ মানের ওষুধ তৈরির কারণে যে নয়টি প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিল হয়েছিল, তারা উচ্চ আদালতের অনুমতি নিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ওষুধ সাধারণ মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবেও সংসদীয় কমিটি চিহ্নিত করেছে।
এ দিকে, মালিকদের সিদ্ধান্তে বাসভাড়া বেড়েছে। সরকার তবুও ব্যবস্থা নেয়নি। আইন অনুযায়ী, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ এবং মালিক পক্ষের মধ্যে আলোচনাসাপেক্ষে সরকারি উচ্চমহল ভাড়া নির্ধারণ এবং এসআরো জারির মাধ্যমে সরকার তা বাস্তবায়ন করে থাকে। সম্প্রতি মালিকেরা সরকারকে পাশ কাটিয়ে একতরফাভাবে বেশি ভাড়া আদায় করে চলেছেন যাত্রীদের জিম্মি করে।
বছর ঘুরে আসার দু-এক মাস আগেই বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়া ৫০০ থেকে দুই-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিতে শুরু করেন। ১৯৯১ সালে প্রণীত বাড়িভাড়া আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও সরকারি নীতি কার্যকর হচ্ছে না। শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ। শিক্ষার বৈষম্য, কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করা আর নোট ও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বইয়ের সংখ্যা শিশু-কিশোরদের ধারণক্ষমতার বেশি। এতে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের গৃহশিক্ষক ও কোচিংমুখিতা বেড়েছে। শিক্ষাব্যয়ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালের বাইরে। যারা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে এবং কোচিং করতে পারছে না, তারা ঝরে যায় অথবা সহপাঠীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে।
চিকিৎসাব্যবস্থায় কতটা নাজুক ও অরাজক পরিস্থিতি বিদ্যমান, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। ডাক্তাররা যে যেমন পারছেন, আদায় করে চলেছেন ফি। সর্দি-কাশি নিয়ে ডাক্তারদের শরণাপন্ন হলে দুই-তিনটা টেস্ট ধরিয়ে দিয়ে বলে থাকেন, অমুক ল্যাব থেকে টেস্ট করিয়ে আনুন। রোগী এসব হুকুম মানতে বাধ্য। শোনা যায়, পরীক্ষা ফির একটা অংশ ডাক্তারদের বখরা দেয়া হয়। সরকার এসব শোনে, কিছু করে না। এখানেও WHO নির্ধারিত, রোগীর অধিকার ভূলুণ্ঠিত।
বাংলাদেশের ভোক্তাদের দুর্ভোগ-দুর্দশা উত্তরণে দেশে আইন বিদ্যমান। এসব আইন বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং দায়িত্বশীল লোক থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই। জনগণের চলছে ভোগান্তি। সরকারি মহলের রয়েছে সদিচ্ছার অভাব।
ভোক্তা অধিকার দিবস উপলক্ষে সিআই-এর ডাইরেক্টর জেনারেল হেলেন এমসি কাম্ভ বলেছেন, ভোক্তাদের জন্য ভালো সুরক্ষা কেবল একটি আইনি বিষয় নয়। এটি ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার এবং জীবন রক্ষার প্রতিশ্রুতিও।
জাতিসঙ্ঘস্বীকৃত ক্রেতা ও ভোক্তাদের আটটি অধিকার ও পাঁচটি দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা সচেতন হলে ভোক্তাদের সমস্যা দূর হতে থাকবে। ভোক্তারা সরকারি মহলের শৈথিল্যের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সোচ্চার ও সংগঠিত হতে শুরু করবেন, তত ভোক্তাস্বার্থ এবং সংশ্লিষ্ট আইন হালনাগাদকরণ ও বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে।
লেখক : এমদাদ হোসেন মালেক, তারিখ: ১৫ মার্চ, ২০১৩, Daily Naya Diganto.
সাধারণ সম্পাদক, কনজুমারস ফোরাম (সিএফ)

0 comments:

Post a Comment