অলিম্পিকে বাংলাদেশের গোল্ড মেডাল জেতার সহজ উপায়...
॥ শফিক রেহমান ॥
স্থান : অলিম্পিক স্টেডিয়ামের কাছে অলিম্পিক ভিলেইজে বাংলাদেশ ক্যাম্প, রিও ডি জেনিরো, ব্রাজিল।
কাল : দুপুর, ৩০০ মিটার স্পৃট ফাইনাল ইভেন্টের কিছু আগে, আগস্ট ২০১৬।
পাত্র : ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার স্পৃন্টে ওয়ার্ল্ড ও অলিম্পিক রেকর্ড হোল্ডার জ্যামাইকার নাগরিক উসেইন সেইন্ট লিও বোল্ট, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের কোচ।
১০০ মিটার স্পৃন্টে গোল্ড মেডাল প্রত্যাশী বাংলাদেশের অ্যাথলিট কেরামত হোসেন পল্টু ওরফে উসেইন পল্টু, যিনি বর্তমানে বিশ্বের দ্রুততম মানবরূপে বিবেচিত।
এবং আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নোবেল-উল ইসলাম ওরফে নোবেল ইসলাম।
সতর্কীকরণ : সকল চরিত্র, সংলাপ ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
দৃশ্য : কেরামত হোসেন পল্টু ওরফে উসেইন পল্টুর রুমে একটা টেলিভিশন চলছে। তাতে দেখা যাচ্ছে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে সমবেত বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ ও সাধারণ দর্শকমণ্ডলী। মাঝে মাঝে ক্যামেরা স্ক্যান করছে বিশিষ্ট অতিথিদের, যাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সহাস্যমুখে। তার ডান পাশে আছেন বাংলাদেশের ফার্স্ট ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী শেখ রেহানা ও বাম পাশে আছেন সেকেন্ড ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী সজীব ওয়াজেদ জয়কে। ক্যামেরা স্ক্যান করছে বিভিন্ন ট্র্যাক ও ফিল্ড ইভেন্ট।
রুমে দরজার ওপরে স্ট্যান্ডবাই লাইট জ্বলছে। যার রং এখন সবুজ। এরপর প্রস্তুতির সংকেত স্বরূপ জ্বলবে হলুদ বাতি। তারপর মাঠে ঢোকার চূড়ান্ত সংকেত স্বরূপ জ্বলবে লাল বাতি।
রুমে ছোট ডাইনিং টেবিলে আছে ম্যাকডোনাল্ডসের ফুড বক্স, কিছু কলা, কোকাকোলার ক্যান, জুসের কার্টন ইত্যাদি।
সিংগল বেডের মাথার দিকে দেয়ালে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো ল্যাটিন ভাষায় অলিম্পিক মটো (Motto) - Citius, Altius, Fortius, ইংরেজিতে Faster, Higher, Stronger (দ্রুততর, উচ্চতর, দৃঢ়তর)।
তার পাশেই লন্ডন ২০১২ অলিম্পিকে উসেইন বোল্টের দৌড়ের ছবি সংবলিত বড় পোস্টার। ওয়ারড্রোবের পাশে একটি সুটকেস ও র্যাকস্যাক।
এক কোনায় একটা ছোট ফৃজ।
বেডসাইড টেবিলে সেদিনের প্রভাতী সংবাদপত্র Jamaica Daily Gleaner (জ্যামাইকা ডেইলি গ্লিনার)-এর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় হেড লাইনে লেখা : Will Polt Break Bolt's Record Today? (উইল পোল্ট ব্রেক বোল্ট’স রেকর্ড টুডে? আজ কি বোল্টের রেকর্ড ভাঙবেন পোল্ট?)
বাংলাদেশের ট্র্যাক ইভেন্টের কোচ উসেইন বোল্টের প্রবেশ।
কেরামত হোসেন পল্টু ওরফে উসেইন পল্টু : গুড ডে স্যার।
বোল্ট : গুড ডে। সব পৃপারেশন কমপ্লিট?
পল্টু : ইয়েস স্যার।
বোল্ট : সকালে কি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করেছ?
পল্টু : আপনার ইন্সট্রাকশন মোতাবেক ম্যাকডোনাল্ডসের ভেজিটেবল র্যাপ, হ্যাশ ব্রাউন (ভাজা আলু ভর্তা), ফ্রেশ ফ্রুট সালাদ, কলা, আপেল জুস।
বোল্ট : গুড। এগুলোই আমি ব্রেকফাস্টে খেয়েছিলাম ৫ আগস্ট ২০১২-তে লন্ডনে ১০০ মিটার স্পৃন্ট ফাইনালের দিনে। অবশ্য তখন সাংবাদিকদের এ তথ্য দেয়ায় কেউ কেউ সমালোচনা করেছিল আমি প্রকারান্তরে ম্যাকডোনাল্ডসের জাংক ফুডের বিজ্ঞাপন দিয়েছি। হলোই বা। আই ডিড নট কেয়ার। আমি ছোটবেলা থেকেই ম্যাকডোনাল্ডস আর কোক ভালোবাসি। এনিওয়ে। লাঞ্চে কি খেয়েছ?
পল্টু : চিকেন নাগেট, বিফ, রাইস আর আপেল জুস। আপনার দেয়া মেনু অনুযায়ী।
বোল্ট : হ্যা। ২০১২-তে এটাই আমার লাঞ্চ মেনু ছিল। তবে আমি বিফ নয়Ñ পর্ক খেয়েছিলাম। তুমি মুসলিম। তাই তোমাকে শূকরের নয়, গরুর মাংস খেতে বলেছিলাম। ট্রেইনিং শেডিউল ঠিক রেখেছ তো?
পল্টু : ইয়েস স্যার। গতকালও বিশ মিনিট সুইমিং, ত্রিশ মিনিট সাইকিং আর বিশ মিনিট দৌড়েছি।
বোল্ট : গুড। আমিও ২০১২-তে ফাইনাল ১৩ সপ্তাহে এই শেডিউল মেইনটেইন করেছিলাম। প্রতি সপ্তাহে পাচ দিন। আর দুই দিন রেস্টে ছিলাম। বেশি বাড়াবাড়ির দরকার নেই। বি রিলাক্সড। টেক ইট ইজি। দর্শকদের চিৎকার, হাততালি, এসবে ভয় পেও না। (পল্টুর পায়ের আঙুল দেখিয়ে) জুতা ঠিকমতো পরেছ তো? চেক ইট। চ্যাম্পিয়ন হবার অনেক আগে ২০০২-তে ওয়ার্ল্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ স্পৃন্টে আমি ডান পায়ের জুতা বামে, আর বাম পায়ের জুতা ডানে পরে দৌড়েছিলাম। ওহ। আই ওয়াজ সো নার্ভাস! তুমি কিন্তু নার্ভাস হবে না। ডোন্ট বি নার্ভাস।
পল্টু (জুতা চেক করে) : হ্যা, স্যার। ঠিক পায়ে ঠিক জুতাই পরেছি।
বোল্ট : চেক ইয়োর শু লেস অলসো। বেইজিং অলিম্পিকে আমার জুতার ফিতা টাইট করে না বাধায় দৌড়ের সময়ে ফিতা খুলে গিয়েছিল। অবশ্য আমিই উইন করেছিলাম। কিন্তু ফিতা বাধা থাকলে আমার টাইমিংটা আরো দ্রুত হতো।
পল্টু (জুতার ফিতা চেক করে) : হ্যা, স্যার। টাইট আছে।
বোল্ট : তোমার হাইটটা সমস্যা। তোমার উচ্চতা মাত্র পাচ ফিট। পনের বছর বয়সেই আমার উচ্চতা হয়েছিল ছয় ফিট পাচ ইঞ্চি। আমি জানি বাংলাদেশে পুষ্টির অভাব চলছে। তাই সব মানুষ ছোট হয়ে যাচ্ছে। কোনো আন্তর্জাতিক স্পোর্টসে তোমরা যে ভালো করতে পারো না, এটা তার একটা বড় কারণ।
পল্টু (কিছুটা গর্বিত স্বরে) : আমি উচ্চতায় পাচ ফিট হলেও এভারেজ বাংলাদেশীদের তুলনায় লম্বা। বাংলাদেশীদের এভারেজ হাইট এখন মাত্র চার ফিট।
বোল্ট : সে জন্যই আমি বেশ চিন্তিত ছিলাম। ¯পৃন্টারদের হাইট সব সময়ই বেশি হয়। আমেরিকার কার্ল লুইস, কানাডার বেন জনসন থেকে শুরু করে আমার দেশ জ্যামাইকার সব স্পৃন্টারের হাইট বেশি। কিন্তু তোমার হাইট খুবই কম। তবে তোমার বডি ওয়েট কম। তার ফলে দৌড়ানোর সময়ে তুমি কিছুটা এডভানটেজ পাবে। তোমার সম্পর্কে এসব জানা সত্ত্বেও আমি উপযাজক হয়ে তোমার কোচিংয়ের ভার নিয়েছি। কারণ তুমি একজন প্রডিজি (Prodigy)। ঈশ্বর-প্রদত্ত অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী তুমি হয়েছ অতি অল্প বয়সে। তাই মাত্র এগারো বছর বয়সে তোমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে। তোমার বয়স এখন মাত্র উনিশ। আমি বেইজিংয়ে প্রথম অলিম্পিক গোল্ড মেডাল যখন জিতেছিলাম তখন আমার বয়স ছিল একুশ। তার চার বছর পর লন্ডন অলিম্পিকে আবার যখন গোল্ড মেডাল জিতলাম, তখন সাংবাদিকরা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ২০১৬-র এই অলিম্পিকে আমি আবার ১০০ মিটার স্পৃন্টে দৌড়াব কি না। তখন আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আই হোপ আই অ্যাম দেয়ারÑ আমি আশা করছি আমি সেখানে থাকব। কিন্তু ২০১৩ থেকে তোমার দৌড় দেখার পর আমি গভীরভাবে চিন্তা করে দুটি সিদ্ধান্তে আসিÑ এক. আমি অলিম্পিক থেকে রিটায়ার করব; দুই. আমার যোগ্য উত্তরসূরিরূপে তোমাকে গড়ে তুলবÑ তোমার কোচ পদে সব দায়িত্ব পালন করব। তার ফলে তুমি গত তিন বছরে যেভাবে এগিয়েছ, সেটা অবিশ্বাস্য, সেটা কল্পনাতীত (একটু এগিয়ে গিয়ে পল্টুর পিঠ চাপড়ে)। আমি জানি আজ আমার আশা পূর্ণ হবে। তুমি বিজয়ী হবে। শুধু তা-ই নয়Ñ আমার রেকর্ড ভেঙে তুমি নতুন ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করবে। সারা দুনিয়া আজ তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তুমিই হবে ওয়ার্ল্ডের নাম্বার ওয়ান ফেমাস পার্সন। তোমার কাছে ছুটে আসবে সব এডভারটাইজররা, টিভিওয়ালারা। (একটু থেমে) আমার সব কথাই তুমি শুনেছ। এমনকি তোমার নাম বদলে উসেইন পল্টু করেছ। অবশ্য আমি সাজেস্ট করেছিলাম তোমার নাম উসেইন পোল্ট রাখতে। তাহলে আমার নামের সাথে তোমার নামের একটা মিল থাকত। নেভার মাইন্ড।
পল্টু (বেডসাইড টেবিলে রাখা নিউজপেপার দেখিয়ে) : আমি না চাইলেও মিডিয়া আমাকে পোল্ট নামেই ডাকছে!
বোল্ট : আমি জানি। শেষ একটা উপদেশ। বেইজিংয়ে যেদিন আমি অলিম্পিক রেকর্ড করি সেদিন দৌড়ের শেষ দিকে বাহবা নেওয়ার জন্য কিছু অঙ্গভঙ্গি করেছিলাম। এক্সপার্টরা বলেছেন, সেটা না করলে এবং আমার জুতার ফিতা বাধা থাকলে, আমার টাইমিং আরো ভালো হতো। জয়ের সময়ে আমার মতো ভুল তুমি কোরো না। সবার প্রতি বিনয়ী থাকবে। সুপারস্টার হলেও সব সময় নম্র থাকবে। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। আমি মাঠে যাচ্ছি। তুমি রেডি হয়ে চলে এসো। গুড লাক।
উসেইন বোল্ট চলে গেলেন।
ঠিক তার পরেই রুমে ঢুকলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নোবেল-উল ইসলাম।
পল্টু (অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে সটান দাড়িয়ে স্যালিউট দিয়ে) : জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জয় শেখ হাসিনা। জয় রেহানা। জয় সজীব জয়। (বিস্মিত চোখে) স্যার! আপনি এখানে! আমি তো জানতাম না।
সৈয়দ নোবেল : লন্ডন অলিম্পিকে নেত্রী মাত্র জনা পঞ্চাশেক ডেলিগেট নিয়ে গিয়েছিলেন। এই চার বছরে বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা আরো বেড়েছে। হয়তো এখন বিশ কোটি। সবাইকে তো খুশি রাখতে হবে। তাই নেত্রীর ডেলিগেশনে এবার দুই শ’ জনকে আনা হয়েছে। আমি তাদের একজন। বসো। বসো। (নিজে একটা চেয়ারে বসলেন। অপর একটি চেয়ারে পল্টুকে বসতে ইঙ্গিত করলেন)। তোমার সব পৃপারেশন শেষ? তুমি রেডি?
এই সময়ে দরজার ওপরে লাইটের রং সবুজ থেকে হলুদ হলো।
পল্টু (চেয়ারে বসে) : হ্যা, স্যার। ওই যে স্যার, হলুদ বাতি জ্বলেছে। আমাকে রেডি হতে বলা হচ্ছে।
সৈয়দ নোবেল : তুমি জ্যামাইকা সম্পর্কে কিছু পড়াশোনা করেছ?
পল্টু (একটু অবাক হয়ে) : জ্যামাইকা বিষয়ে?
সৈয়দ নোবেল : হ্যা। জ্যামাইকা। তুমি জানো জ্যামাইকার আয়তন কত? জ্যামাইকার জনসংখ্যা কত?
পল্টু : জানি স্যার। জ্যামাইকার আয়তন প্রায় এগারো হাজার বর্গমাইল। বাংলাদেশের তুলনায় পাচ ভাগের এক ভাগ মাত্র। তাদের জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। জ্যামাইকা লন্ডন অলিম্পিকে চারটি গোল্ড, চারটি সিলভার ও চারটি ব্রোঞ্জ, মোট বারোটি মেডাল পেয়েছিল। মেডাল বিজয়ী দেশগুলোর লিস্টে জ্যামাইকার স্থান ছিল আঠারো। খুবই প্রশংসনীয় পারফরমেন্স ছিল জ্যামাইকার।
সৈয়দ নোবেল : আর বাংলাদেশের স্থান?
পল্টু : বাংলাদেশ কোনো ইভেন্টের ফাইনালে উঠতে পারেনি। গোল্ড মেডাল তো অনেক দূরের কথা। বাংলাদেশ ওয়াইল্ড কার্ডে অর্থাৎ লটারিতে কিছু ইভেন্টের হিটে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিল।
সৈয়দ নোবেল : এবার কি হবে?
পল্টু : (আত্মবিশ্বাসের স্বরে) : এবার বাংলাদেশ অন্তত একটি গোল্ড মেডাল পাবে। আমি পাবো স্যার। ইনশাআল্লাহ।
সৈয়দ নোবেল : তুমি কি সত্যিই সেটা বিশ্বাস করো?
পল্টু : হ্যা, স্যার। শুধু গোল্ড মেডাল জেতাই নয়, আমি নতুন ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করার আশা রাখি। ইনশাআল্লাহ।
সৈয়দ নোবেল (গম্ভীর মুখে) : তুমি জ্যামাইকা সম্পর্কে আর কি জানো? জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী কে?
পল্টু (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) : জানি না স্যার। সরি।
সৈয়দ নোবেল : জ্যামাইকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন মিসেস পোর্শিয়া সিমসন মিলার। তিনি পিপলস ন্যাশনাল পার্টি, সংক্ষেপে পিএনপির নেত্রী। ২৯ ডিসেম্বর ২০১১-র সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি ক্ষমতাসীন হয়েছেন।
পল্টু : জানলাম স্যার। থ্যাংক ইউ।
সৈয়দ নোবেল : জ্যামাইকা এক সময়ে বৃটিশ শাসনাধীন ছিল। তুমি কি জানো স্বাধীনতার পর জ্যামাইকার প্রথম প্রধানমন্ত্রী কে হয়েছিলেন?
পল্টু (লজ্জিত স্বরে) : সরি স্যার।
সৈয়দ নোবেল : ১৯৬২-তে জ্যামাইকা স্বাধীন হবার পরে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন আলেকজান্দার কার্ক বাস্টুমান্টে। তিনি আলেকজান্দার বাস্টুমান্টে নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তার জন্ম হয়েছিল ১৮৮৪-তে জ্যামাইকাতে। তিনি বিশ্ব ভ্রমণ করেন এবং এক সময়ে কিউবাতে পুলিশ এবং নিউ ইয়র্ক সিটির একটি হসপিটালে ডায়েটিশিয়ান রূপে কাজ করেন। ১৯৩২-এ দেশে ফিরে গিয়ে ডেইলি গ্লিনার পত্রিকায় কলাম লিখে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারপর দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০-এ তার জেলদণ্ড হয়। ১৯৪৩-এ জেলমুক্ত হয়ে তিনি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জ্যামাইকা লেবার পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত তিনি স্বাধীন জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬৯-এ তাকে ন্যাশনাল হিরো অফ জ্যামাইকা বা জ্যামাইকার জাতীয় বীর উপাধি দেওয়া হয়। জ্যামাইকার জনপ্রিয় মিষ্টি নারকেল কুচি ও চিনি দিয়ে তৈরি গিজাদা (Gijjada)-র নতুন নাম হয় বাস্টুমান্টে ব্যাকবোন বা বাস্টুমান্টে মেরুদণ্ড। তার কারণ, তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে কখনোই আপোষ করেননি। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল। ৯৩ বছর বয়সে ১৯৭৭-এ আলেকজান্দার বাস্টুমান্টে মারা যান। (একটু চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলেন)। তুমি এ সব কিছুই জানতে না।
পল্টু (মুখ নিচু করে) : খুবই সরি স্যার।
সৈয়দ নোবেল : তুমি যে জানতে না সে জন্য তোমাকে দোষ দেব না। দোষ দেব উসেইন বোল্টকে। তুমি জানো উসেইন বোল্টকে। সারা দুনিয়ার লোক জানে উসেইন বোল্টকে। কেউ জানে না আলেকজান্দার বাস্টুমান্টেকে। কেউ জানে না পোর্শিয়া সিমসন মিলারকে। কারণটা কি? কারণ উসেইন বোল্ট অলিম্পিকে গোল্ড মেডাল পেয়েছেন। কারণ উসেইন বোল্ট ২০০৯-এ বার্লিনে ১০০ মিটার স্পৃন্টে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেছেন। সব দোষ যে তার একথা তুমি স্বীকার করো?
পল্টু : হ্যা, স্যার।
সৈয়দ নোবেল : (পল্টুর দিকে ঝুকে পড়ে) তাহলে একজন দেশপ্রেমিক হলে তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না যে, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনকেরও এই একই পরিণতি হোক।
পল্টু (বিব্রত স্বরে) : না, স্যার।
সৈয়দ নোবেল (উঠে দাড়িয়ে) : লাভলি! তোমার কাছে ঠিক উত্তরটাই আমি আশা করেছিলাম। আমি জানতাম তুমি বুঝবে অলিম্পিকে তুমি যদি গোল্ড মেডাল পাও তাহলে দুনিয়া জুড়ে তার কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে। ড. ইউনূসের নোবেল প্রাইজ পাবার প্রতিক্রিয়া তো এর তুলনায় কিছুই নয়। কয়েক শ’ কোটি মানুষ টিভিতে এই দৌড় দেখবে। সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যাবে তোমাকে নিয়ে। বাংলাদেশের পরিচয় হবে তোমাকে দিয়ে। তোমাকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে মাতামাতি চলবে। বাংলাদেশ হবে কেরামত হোসেন পল্টুর দেশ। তুমি যত বড় কেরামতিই দেখাও না কেন, এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। ইমপসিবল। অসম্ভব।
পল্টু উঠে দাড়িয়ে নিশ্চুপ থাকল।
হলুদ বাতির রং বদলে লাল বাতি হলো।
পল্টুকে এখনই যেতে হবে।
পল্টু : আমি কি করবো স্যার? ওই যে মাঠে যাওয়ার সিগন্যাল জ্বলছে।
সৈয়দ নোবেল : অবশ্যই তুমি মাঠে যাবে এবং দৌড়াবেও। (একটা গ্লাসে একটু জুস ঢেলে এবং পকেট থেকে এক স্টৃপ ট্যাবলেট বের করে) তবে যাবার আগে এই ট্যাবলেটগুলো খেয়ে যাবে।
পল্টু (চরম বিস্মিতভাবে) : ট্যাবলেট? এটা কি ট্যাবলেট?
সৈয়দ নোবেল : এমফিটামিন ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেটগুলো খেয়ে তুমি দৌড়াবে। এগুলো শক্তিবর্ধক ট্যাবলেট। দৌড়ের পর যখন তোমার ব্লাড স্যাম্পল নেয়া হবে তুমি কোনো ড্রাগস খেয়েছিলে কি না সেটা বোঝার জন্যÑ তখন কর্তৃপক্ষ জানবে তুমি এই ড্রাগস খেয়ে দৌড়েছিলে। তুমি ফার্স্ট হবে ঠিকইÑ কিন্তু স্বীকৃতি পাবে না। গোল্ড মেডালও পাবে না। তবে বাংলাদেশে তুমি দেশপ্রেমিকরূপে স্বীকৃতি পাবে। তোমাকে প্রথমে একুশে পদক এবং পরের বছর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হবে।
পল্টু : ড্রাগস টেস্টে ধরা পড়ে গোল্ড মেডাল না পেলে আপনার নেত্রী নিশ্চয়ই প্রচণ্ড হতাশ হবেন। আমার ওপর রাগ করবেন। পদক না দিয়ে দেশে হয়তো আমার বিচার করবেন।
সৈয়দ নোবেল (মৃদু হাসিমুখে) : নেত্রীর নির্দেশেই তো আমি তোমার কাছে এসেছি। তিনি সব জানেন। ইউনূস অ্যাফেয়ারের রিপিট শো তিনি চান না।
পল্টু : (ুব্ধ মুখে) তিনি তাহলে আমার দৌড় দেখতে অলিম্পিকে আসেননি!
সৈয়দ নোবেল : না। তিনি বেড়াতে এসেছেন মাত্র। যেমনটা লন্ডন অলিম্পিকে গিয়েছিলেন উদ্বোধনী ও সমাপ্তি অনুষ্ঠানÑ দুটোই দেখার জন্য (গ্লাস আর ট্যাবলেট স্টৃপ এগিয়ে দিয়ে)। আর দেরি কোরো না। খেয়ে নাও।
লাল বাতি একবার জ্বলা এবং আরেকবার নেভা শুরু করল।
কর্কশ শব্দে এলার্ম বাজতে থাকল।
ক্রর, ক্রর, ক্রর...
২৬ আগস্ট, ২০১২
স্থান : অলিম্পিক স্টেডিয়ামের কাছে অলিম্পিক ভিলেইজে বাংলাদেশ ক্যাম্প, রিও ডি জেনিরো, ব্রাজিল।
কাল : দুপুর, ৩০০ মিটার স্পৃট ফাইনাল ইভেন্টের কিছু আগে, আগস্ট ২০১৬।
পাত্র : ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার স্পৃন্টে ওয়ার্ল্ড ও অলিম্পিক রেকর্ড হোল্ডার জ্যামাইকার নাগরিক উসেইন সেইন্ট লিও বোল্ট, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের কোচ।
১০০ মিটার স্পৃন্টে গোল্ড মেডাল প্রত্যাশী বাংলাদেশের অ্যাথলিট কেরামত হোসেন পল্টু ওরফে উসেইন পল্টু, যিনি বর্তমানে বিশ্বের দ্রুততম মানবরূপে বিবেচিত।
এবং আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নোবেল-উল ইসলাম ওরফে নোবেল ইসলাম।
সতর্কীকরণ : সকল চরিত্র, সংলাপ ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
দৃশ্য : কেরামত হোসেন পল্টু ওরফে উসেইন পল্টুর রুমে একটা টেলিভিশন চলছে। তাতে দেখা যাচ্ছে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে সমবেত বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ ও সাধারণ দর্শকমণ্ডলী। মাঝে মাঝে ক্যামেরা স্ক্যান করছে বিশিষ্ট অতিথিদের, যাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সহাস্যমুখে। তার ডান পাশে আছেন বাংলাদেশের ফার্স্ট ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী শেখ রেহানা ও বাম পাশে আছেন সেকেন্ড ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী সজীব ওয়াজেদ জয়কে। ক্যামেরা স্ক্যান করছে বিভিন্ন ট্র্যাক ও ফিল্ড ইভেন্ট।
রুমে দরজার ওপরে স্ট্যান্ডবাই লাইট জ্বলছে। যার রং এখন সবুজ। এরপর প্রস্তুতির সংকেত স্বরূপ জ্বলবে হলুদ বাতি। তারপর মাঠে ঢোকার চূড়ান্ত সংকেত স্বরূপ জ্বলবে লাল বাতি।
রুমে ছোট ডাইনিং টেবিলে আছে ম্যাকডোনাল্ডসের ফুড বক্স, কিছু কলা, কোকাকোলার ক্যান, জুসের কার্টন ইত্যাদি।
সিংগল বেডের মাথার দিকে দেয়ালে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো ল্যাটিন ভাষায় অলিম্পিক মটো (Motto) - Citius, Altius, Fortius, ইংরেজিতে Faster, Higher, Stronger (দ্রুততর, উচ্চতর, দৃঢ়তর)।
তার পাশেই লন্ডন ২০১২ অলিম্পিকে উসেইন বোল্টের দৌড়ের ছবি সংবলিত বড় পোস্টার। ওয়ারড্রোবের পাশে একটি সুটকেস ও র্যাকস্যাক।
এক কোনায় একটা ছোট ফৃজ।
বেডসাইড টেবিলে সেদিনের প্রভাতী সংবাদপত্র Jamaica Daily Gleaner (জ্যামাইকা ডেইলি গ্লিনার)-এর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় হেড লাইনে লেখা : Will Polt Break Bolt's Record Today? (উইল পোল্ট ব্রেক বোল্ট’স রেকর্ড টুডে? আজ কি বোল্টের রেকর্ড ভাঙবেন পোল্ট?)
বাংলাদেশের ট্র্যাক ইভেন্টের কোচ উসেইন বোল্টের প্রবেশ।
কেরামত হোসেন পল্টু ওরফে উসেইন পল্টু : গুড ডে স্যার।
বোল্ট : গুড ডে। সব পৃপারেশন কমপ্লিট?
পল্টু : ইয়েস স্যার।
বোল্ট : সকালে কি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করেছ?
পল্টু : আপনার ইন্সট্রাকশন মোতাবেক ম্যাকডোনাল্ডসের ভেজিটেবল র্যাপ, হ্যাশ ব্রাউন (ভাজা আলু ভর্তা), ফ্রেশ ফ্রুট সালাদ, কলা, আপেল জুস।
বোল্ট : গুড। এগুলোই আমি ব্রেকফাস্টে খেয়েছিলাম ৫ আগস্ট ২০১২-তে লন্ডনে ১০০ মিটার স্পৃন্ট ফাইনালের দিনে। অবশ্য তখন সাংবাদিকদের এ তথ্য দেয়ায় কেউ কেউ সমালোচনা করেছিল আমি প্রকারান্তরে ম্যাকডোনাল্ডসের জাংক ফুডের বিজ্ঞাপন দিয়েছি। হলোই বা। আই ডিড নট কেয়ার। আমি ছোটবেলা থেকেই ম্যাকডোনাল্ডস আর কোক ভালোবাসি। এনিওয়ে। লাঞ্চে কি খেয়েছ?
পল্টু : চিকেন নাগেট, বিফ, রাইস আর আপেল জুস। আপনার দেয়া মেনু অনুযায়ী।
বোল্ট : হ্যা। ২০১২-তে এটাই আমার লাঞ্চ মেনু ছিল। তবে আমি বিফ নয়Ñ পর্ক খেয়েছিলাম। তুমি মুসলিম। তাই তোমাকে শূকরের নয়, গরুর মাংস খেতে বলেছিলাম। ট্রেইনিং শেডিউল ঠিক রেখেছ তো?
পল্টু : ইয়েস স্যার। গতকালও বিশ মিনিট সুইমিং, ত্রিশ মিনিট সাইকিং আর বিশ মিনিট দৌড়েছি।
বোল্ট : গুড। আমিও ২০১২-তে ফাইনাল ১৩ সপ্তাহে এই শেডিউল মেইনটেইন করেছিলাম। প্রতি সপ্তাহে পাচ দিন। আর দুই দিন রেস্টে ছিলাম। বেশি বাড়াবাড়ির দরকার নেই। বি রিলাক্সড। টেক ইট ইজি। দর্শকদের চিৎকার, হাততালি, এসবে ভয় পেও না। (পল্টুর পায়ের আঙুল দেখিয়ে) জুতা ঠিকমতো পরেছ তো? চেক ইট। চ্যাম্পিয়ন হবার অনেক আগে ২০০২-তে ওয়ার্ল্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ স্পৃন্টে আমি ডান পায়ের জুতা বামে, আর বাম পায়ের জুতা ডানে পরে দৌড়েছিলাম। ওহ। আই ওয়াজ সো নার্ভাস! তুমি কিন্তু নার্ভাস হবে না। ডোন্ট বি নার্ভাস।
পল্টু (জুতা চেক করে) : হ্যা, স্যার। ঠিক পায়ে ঠিক জুতাই পরেছি।
বোল্ট : চেক ইয়োর শু লেস অলসো। বেইজিং অলিম্পিকে আমার জুতার ফিতা টাইট করে না বাধায় দৌড়ের সময়ে ফিতা খুলে গিয়েছিল। অবশ্য আমিই উইন করেছিলাম। কিন্তু ফিতা বাধা থাকলে আমার টাইমিংটা আরো দ্রুত হতো।
পল্টু (জুতার ফিতা চেক করে) : হ্যা, স্যার। টাইট আছে।
বোল্ট : তোমার হাইটটা সমস্যা। তোমার উচ্চতা মাত্র পাচ ফিট। পনের বছর বয়সেই আমার উচ্চতা হয়েছিল ছয় ফিট পাচ ইঞ্চি। আমি জানি বাংলাদেশে পুষ্টির অভাব চলছে। তাই সব মানুষ ছোট হয়ে যাচ্ছে। কোনো আন্তর্জাতিক স্পোর্টসে তোমরা যে ভালো করতে পারো না, এটা তার একটা বড় কারণ।
পল্টু (কিছুটা গর্বিত স্বরে) : আমি উচ্চতায় পাচ ফিট হলেও এভারেজ বাংলাদেশীদের তুলনায় লম্বা। বাংলাদেশীদের এভারেজ হাইট এখন মাত্র চার ফিট।
বোল্ট : সে জন্যই আমি বেশ চিন্তিত ছিলাম। ¯পৃন্টারদের হাইট সব সময়ই বেশি হয়। আমেরিকার কার্ল লুইস, কানাডার বেন জনসন থেকে শুরু করে আমার দেশ জ্যামাইকার সব স্পৃন্টারের হাইট বেশি। কিন্তু তোমার হাইট খুবই কম। তবে তোমার বডি ওয়েট কম। তার ফলে দৌড়ানোর সময়ে তুমি কিছুটা এডভানটেজ পাবে। তোমার সম্পর্কে এসব জানা সত্ত্বেও আমি উপযাজক হয়ে তোমার কোচিংয়ের ভার নিয়েছি। কারণ তুমি একজন প্রডিজি (Prodigy)। ঈশ্বর-প্রদত্ত অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী তুমি হয়েছ অতি অল্প বয়সে। তাই মাত্র এগারো বছর বয়সে তোমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে। তোমার বয়স এখন মাত্র উনিশ। আমি বেইজিংয়ে প্রথম অলিম্পিক গোল্ড মেডাল যখন জিতেছিলাম তখন আমার বয়স ছিল একুশ। তার চার বছর পর লন্ডন অলিম্পিকে আবার যখন গোল্ড মেডাল জিতলাম, তখন সাংবাদিকরা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ২০১৬-র এই অলিম্পিকে আমি আবার ১০০ মিটার স্পৃন্টে দৌড়াব কি না। তখন আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আই হোপ আই অ্যাম দেয়ারÑ আমি আশা করছি আমি সেখানে থাকব। কিন্তু ২০১৩ থেকে তোমার দৌড় দেখার পর আমি গভীরভাবে চিন্তা করে দুটি সিদ্ধান্তে আসিÑ এক. আমি অলিম্পিক থেকে রিটায়ার করব; দুই. আমার যোগ্য উত্তরসূরিরূপে তোমাকে গড়ে তুলবÑ তোমার কোচ পদে সব দায়িত্ব পালন করব। তার ফলে তুমি গত তিন বছরে যেভাবে এগিয়েছ, সেটা অবিশ্বাস্য, সেটা কল্পনাতীত (একটু এগিয়ে গিয়ে পল্টুর পিঠ চাপড়ে)। আমি জানি আজ আমার আশা পূর্ণ হবে। তুমি বিজয়ী হবে। শুধু তা-ই নয়Ñ আমার রেকর্ড ভেঙে তুমি নতুন ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করবে। সারা দুনিয়া আজ তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তুমিই হবে ওয়ার্ল্ডের নাম্বার ওয়ান ফেমাস পার্সন। তোমার কাছে ছুটে আসবে সব এডভারটাইজররা, টিভিওয়ালারা। (একটু থেমে) আমার সব কথাই তুমি শুনেছ। এমনকি তোমার নাম বদলে উসেইন পল্টু করেছ। অবশ্য আমি সাজেস্ট করেছিলাম তোমার নাম উসেইন পোল্ট রাখতে। তাহলে আমার নামের সাথে তোমার নামের একটা মিল থাকত। নেভার মাইন্ড।
পল্টু (বেডসাইড টেবিলে রাখা নিউজপেপার দেখিয়ে) : আমি না চাইলেও মিডিয়া আমাকে পোল্ট নামেই ডাকছে!
বোল্ট : আমি জানি। শেষ একটা উপদেশ। বেইজিংয়ে যেদিন আমি অলিম্পিক রেকর্ড করি সেদিন দৌড়ের শেষ দিকে বাহবা নেওয়ার জন্য কিছু অঙ্গভঙ্গি করেছিলাম। এক্সপার্টরা বলেছেন, সেটা না করলে এবং আমার জুতার ফিতা বাধা থাকলে, আমার টাইমিং আরো ভালো হতো। জয়ের সময়ে আমার মতো ভুল তুমি কোরো না। সবার প্রতি বিনয়ী থাকবে। সুপারস্টার হলেও সব সময় নম্র থাকবে। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। আমি মাঠে যাচ্ছি। তুমি রেডি হয়ে চলে এসো। গুড লাক।
উসেইন বোল্ট চলে গেলেন।
ঠিক তার পরেই রুমে ঢুকলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নোবেল-উল ইসলাম।
পল্টু (অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে সটান দাড়িয়ে স্যালিউট দিয়ে) : জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জয় শেখ হাসিনা। জয় রেহানা। জয় সজীব জয়। (বিস্মিত চোখে) স্যার! আপনি এখানে! আমি তো জানতাম না।
সৈয়দ নোবেল : লন্ডন অলিম্পিকে নেত্রী মাত্র জনা পঞ্চাশেক ডেলিগেট নিয়ে গিয়েছিলেন। এই চার বছরে বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা আরো বেড়েছে। হয়তো এখন বিশ কোটি। সবাইকে তো খুশি রাখতে হবে। তাই নেত্রীর ডেলিগেশনে এবার দুই শ’ জনকে আনা হয়েছে। আমি তাদের একজন। বসো। বসো। (নিজে একটা চেয়ারে বসলেন। অপর একটি চেয়ারে পল্টুকে বসতে ইঙ্গিত করলেন)। তোমার সব পৃপারেশন শেষ? তুমি রেডি?
এই সময়ে দরজার ওপরে লাইটের রং সবুজ থেকে হলুদ হলো।
পল্টু (চেয়ারে বসে) : হ্যা, স্যার। ওই যে স্যার, হলুদ বাতি জ্বলেছে। আমাকে রেডি হতে বলা হচ্ছে।
সৈয়দ নোবেল : তুমি জ্যামাইকা সম্পর্কে কিছু পড়াশোনা করেছ?
পল্টু (একটু অবাক হয়ে) : জ্যামাইকা বিষয়ে?
সৈয়দ নোবেল : হ্যা। জ্যামাইকা। তুমি জানো জ্যামাইকার আয়তন কত? জ্যামাইকার জনসংখ্যা কত?
পল্টু : জানি স্যার। জ্যামাইকার আয়তন প্রায় এগারো হাজার বর্গমাইল। বাংলাদেশের তুলনায় পাচ ভাগের এক ভাগ মাত্র। তাদের জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। জ্যামাইকা লন্ডন অলিম্পিকে চারটি গোল্ড, চারটি সিলভার ও চারটি ব্রোঞ্জ, মোট বারোটি মেডাল পেয়েছিল। মেডাল বিজয়ী দেশগুলোর লিস্টে জ্যামাইকার স্থান ছিল আঠারো। খুবই প্রশংসনীয় পারফরমেন্স ছিল জ্যামাইকার।
সৈয়দ নোবেল : আর বাংলাদেশের স্থান?
পল্টু : বাংলাদেশ কোনো ইভেন্টের ফাইনালে উঠতে পারেনি। গোল্ড মেডাল তো অনেক দূরের কথা। বাংলাদেশ ওয়াইল্ড কার্ডে অর্থাৎ লটারিতে কিছু ইভেন্টের হিটে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিল।
সৈয়দ নোবেল : এবার কি হবে?
পল্টু : (আত্মবিশ্বাসের স্বরে) : এবার বাংলাদেশ অন্তত একটি গোল্ড মেডাল পাবে। আমি পাবো স্যার। ইনশাআল্লাহ।
সৈয়দ নোবেল : তুমি কি সত্যিই সেটা বিশ্বাস করো?
পল্টু : হ্যা, স্যার। শুধু গোল্ড মেডাল জেতাই নয়, আমি নতুন ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করার আশা রাখি। ইনশাআল্লাহ।
সৈয়দ নোবেল (গম্ভীর মুখে) : তুমি জ্যামাইকা সম্পর্কে আর কি জানো? জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী কে?
পল্টু (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) : জানি না স্যার। সরি।
সৈয়দ নোবেল : জ্যামাইকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন মিসেস পোর্শিয়া সিমসন মিলার। তিনি পিপলস ন্যাশনাল পার্টি, সংক্ষেপে পিএনপির নেত্রী। ২৯ ডিসেম্বর ২০১১-র সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি ক্ষমতাসীন হয়েছেন।
পল্টু : জানলাম স্যার। থ্যাংক ইউ।
সৈয়দ নোবেল : জ্যামাইকা এক সময়ে বৃটিশ শাসনাধীন ছিল। তুমি কি জানো স্বাধীনতার পর জ্যামাইকার প্রথম প্রধানমন্ত্রী কে হয়েছিলেন?
পল্টু (লজ্জিত স্বরে) : সরি স্যার।
সৈয়দ নোবেল : ১৯৬২-তে জ্যামাইকা স্বাধীন হবার পরে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন আলেকজান্দার কার্ক বাস্টুমান্টে। তিনি আলেকজান্দার বাস্টুমান্টে নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তার জন্ম হয়েছিল ১৮৮৪-তে জ্যামাইকাতে। তিনি বিশ্ব ভ্রমণ করেন এবং এক সময়ে কিউবাতে পুলিশ এবং নিউ ইয়র্ক সিটির একটি হসপিটালে ডায়েটিশিয়ান রূপে কাজ করেন। ১৯৩২-এ দেশে ফিরে গিয়ে ডেইলি গ্লিনার পত্রিকায় কলাম লিখে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারপর দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০-এ তার জেলদণ্ড হয়। ১৯৪৩-এ জেলমুক্ত হয়ে তিনি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জ্যামাইকা লেবার পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত তিনি স্বাধীন জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬৯-এ তাকে ন্যাশনাল হিরো অফ জ্যামাইকা বা জ্যামাইকার জাতীয় বীর উপাধি দেওয়া হয়। জ্যামাইকার জনপ্রিয় মিষ্টি নারকেল কুচি ও চিনি দিয়ে তৈরি গিজাদা (Gijjada)-র নতুন নাম হয় বাস্টুমান্টে ব্যাকবোন বা বাস্টুমান্টে মেরুদণ্ড। তার কারণ, তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে কখনোই আপোষ করেননি। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল। ৯৩ বছর বয়সে ১৯৭৭-এ আলেকজান্দার বাস্টুমান্টে মারা যান। (একটু চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলেন)। তুমি এ সব কিছুই জানতে না।
পল্টু (মুখ নিচু করে) : খুবই সরি স্যার।
সৈয়দ নোবেল : তুমি যে জানতে না সে জন্য তোমাকে দোষ দেব না। দোষ দেব উসেইন বোল্টকে। তুমি জানো উসেইন বোল্টকে। সারা দুনিয়ার লোক জানে উসেইন বোল্টকে। কেউ জানে না আলেকজান্দার বাস্টুমান্টেকে। কেউ জানে না পোর্শিয়া সিমসন মিলারকে। কারণটা কি? কারণ উসেইন বোল্ট অলিম্পিকে গোল্ড মেডাল পেয়েছেন। কারণ উসেইন বোল্ট ২০০৯-এ বার্লিনে ১০০ মিটার স্পৃন্টে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেছেন। সব দোষ যে তার একথা তুমি স্বীকার করো?
পল্টু : হ্যা, স্যার।
সৈয়দ নোবেল : (পল্টুর দিকে ঝুকে পড়ে) তাহলে একজন দেশপ্রেমিক হলে তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না যে, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনকেরও এই একই পরিণতি হোক।
পল্টু (বিব্রত স্বরে) : না, স্যার।
সৈয়দ নোবেল (উঠে দাড়িয়ে) : লাভলি! তোমার কাছে ঠিক উত্তরটাই আমি আশা করেছিলাম। আমি জানতাম তুমি বুঝবে অলিম্পিকে তুমি যদি গোল্ড মেডাল পাও তাহলে দুনিয়া জুড়ে তার কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে। ড. ইউনূসের নোবেল প্রাইজ পাবার প্রতিক্রিয়া তো এর তুলনায় কিছুই নয়। কয়েক শ’ কোটি মানুষ টিভিতে এই দৌড় দেখবে। সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যাবে তোমাকে নিয়ে। বাংলাদেশের পরিচয় হবে তোমাকে দিয়ে। তোমাকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে মাতামাতি চলবে। বাংলাদেশ হবে কেরামত হোসেন পল্টুর দেশ। তুমি যত বড় কেরামতিই দেখাও না কেন, এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। ইমপসিবল। অসম্ভব।
পল্টু উঠে দাড়িয়ে নিশ্চুপ থাকল।
হলুদ বাতির রং বদলে লাল বাতি হলো।
পল্টুকে এখনই যেতে হবে।
পল্টু : আমি কি করবো স্যার? ওই যে মাঠে যাওয়ার সিগন্যাল জ্বলছে।
সৈয়দ নোবেল : অবশ্যই তুমি মাঠে যাবে এবং দৌড়াবেও। (একটা গ্লাসে একটু জুস ঢেলে এবং পকেট থেকে এক স্টৃপ ট্যাবলেট বের করে) তবে যাবার আগে এই ট্যাবলেটগুলো খেয়ে যাবে।
পল্টু (চরম বিস্মিতভাবে) : ট্যাবলেট? এটা কি ট্যাবলেট?
সৈয়দ নোবেল : এমফিটামিন ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেটগুলো খেয়ে তুমি দৌড়াবে। এগুলো শক্তিবর্ধক ট্যাবলেট। দৌড়ের পর যখন তোমার ব্লাড স্যাম্পল নেয়া হবে তুমি কোনো ড্রাগস খেয়েছিলে কি না সেটা বোঝার জন্যÑ তখন কর্তৃপক্ষ জানবে তুমি এই ড্রাগস খেয়ে দৌড়েছিলে। তুমি ফার্স্ট হবে ঠিকইÑ কিন্তু স্বীকৃতি পাবে না। গোল্ড মেডালও পাবে না। তবে বাংলাদেশে তুমি দেশপ্রেমিকরূপে স্বীকৃতি পাবে। তোমাকে প্রথমে একুশে পদক এবং পরের বছর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হবে।
পল্টু : ড্রাগস টেস্টে ধরা পড়ে গোল্ড মেডাল না পেলে আপনার নেত্রী নিশ্চয়ই প্রচণ্ড হতাশ হবেন। আমার ওপর রাগ করবেন। পদক না দিয়ে দেশে হয়তো আমার বিচার করবেন।
সৈয়দ নোবেল (মৃদু হাসিমুখে) : নেত্রীর নির্দেশেই তো আমি তোমার কাছে এসেছি। তিনি সব জানেন। ইউনূস অ্যাফেয়ারের রিপিট শো তিনি চান না।
পল্টু : (ুব্ধ মুখে) তিনি তাহলে আমার দৌড় দেখতে অলিম্পিকে আসেননি!
সৈয়দ নোবেল : না। তিনি বেড়াতে এসেছেন মাত্র। যেমনটা লন্ডন অলিম্পিকে গিয়েছিলেন উদ্বোধনী ও সমাপ্তি অনুষ্ঠানÑ দুটোই দেখার জন্য (গ্লাস আর ট্যাবলেট স্টৃপ এগিয়ে দিয়ে)। আর দেরি কোরো না। খেয়ে নাও।
লাল বাতি একবার জ্বলা এবং আরেকবার নেভা শুরু করল।
কর্কশ শব্দে এলার্ম বাজতে থাকল।
ক্রর, ক্রর, ক্রর...
২৬ আগস্ট, ২০১২
0 comments:
Post a Comment