ভাগ্য বদলের নামে প্রতারণাঃ সচেতনামূলক পোস্ট
মানুষ আর কত প্রতারিত হবে ভন্ডদের হাত থেকে, ভাবুন ও চোখ মুখ খোলা রাখুন !
মানুষ
ঠকানোই এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর
পেশা। তাদের
হাতের মুঠোয় থাকে জিন-পরী! কেউ গুরুসম্রাট
আবার কেউবা মুশকিলে আসান। প্রলোভনমূলক
নানা কথা বলে মওকা
বুঝে নানা সমস্যার রক্ষাকবচ
হিসেবে তারা বিক্রি করছেন
রকমারী নামের পাথর।
ভাগ্য বদলের আশায় চড়া
দামে পাথর কিনে অনেকেই
হচ্ছেন প্রতারিত। কিন্তু
পাথরে কি আসলে ভাগ্য
ফেরে?
সব সমস্যার সমাধান
এক
জায়গায়
স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য, প্রেমে ব্যর্থতা, পড়লেখায়
অমনোযোগী, অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য
করা, শত্র“ দমন, বিদেশ
যাত্রায় বাধা, ব্যবসায় উন্নতি,
জাদুটোনা ও ভূত-জ্বিনের
আছড় কাটানো, নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান লাভ, মনের
মানুষকে আয়ত্তে আনাÑ সবই
তারা করতে পারেন ঐশ্বরিক
ক্ষমতায় এমনটাই দাবি তাদের। মনভোলানো
বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট
করার পথ করে নেন
তারা। আর
সহজ সরল মানুষকে ফতুর
করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলাই হল
তাদের শেষ চিকিৎসা।
এমন বহু উদাহরণ সমাজে। তারপরও
তাদের জাদুর পরশ হাতছানি
দিয়ে ডাকছে বিপদগ্রস্তদের।
হয়তো সমস্যার সমাধান হবেÑ এ
আশায় ছুটে যান তারা। অনেকের
সমস্যার সমাধান হয়তো প্রাকৃতিকভাবেই
হয়ে যায়। কিন্তু
তারা ভাবে ঐ পাথর
কিংবা পীরের জন্যই হয়তো
সমাধান সম্ভব হয়েছে।
জ্যোতিষ শাস্ত্র
কি বিজ্ঞান?
এ প্রশ্ন যেমন আগেও
ছিল এই একবিংশ শতাব্দীতেও
আছে। বিজ্ঞান
পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তত্ত্ব-উপাত্তের মধ্য
দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞান
পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রহস্য উšে§াচন করে।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন পর্যায়কে ভাগ করলে আটটি
ধাপ পাওয়া যায়।
সেগুলো হল : ১. পর্যবেক্ষণ
২. তুলনাকরণ ৩. শ্রেণীকরণ ৪.
পরিমাণ নির্ধারণ ৫. পরিমাপন ৬.
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ৭. সিদ্ধান্ত গ্রহণ
ও ৮. ভবিষ্যদ্বাণীকরণ।
জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞানের এসব পর্যায় অবলম্বন
করে গড়ে ওঠেনি বলে
জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত নয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে
জোতিষশাস্ত্র
যারা পাথরের ব্যবসায় করছে
তারা বিশেষ করে ইসলাম
ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে
প্রতারিত করে এ ব্যবসায়
করছে। জাদু,
ভাগ্য গণনা, গণক, জ্যোতিষী,
জাদুকর ও ভেলকিবাজ ফকিরের
শরণাপন্ন হওয়ার ব্যাপারে হুশিয়ার
করে লালবাগ শাহী মসজিদের
ইমাম বলেন, প্রথমত ইসলামে
ধোঁকাবাজদের কোন জায়গা নেই। দ্বিতীয়ত
আল্লাহকে দূরে ঠেলে দিয়ে
রিজিক ও ভাগ্য বদলানোর
জন্য পাথরকে বিশ্বাস করলে
আল্লাহর সাথে শিরক করা
হবে। আর
আল্লাহতায়ালা সব গোনাহ ক্ষমা
করলেও শিরক ক্ষমা করবেন
না। তাই
মুসলমানদের এই ফিতনাহ থেকে
সতর্ক থাকতে হবে।
জ্যোতিষীরা ফুটপাত
ছেড়ে অভিজাত বিপণিতে
এক সময় রাস্তার পাশে
ফুটপাতে জ্যোতিষীদের সন্ধান মিলত।
সময়ের বিবর্তনে তারা এখন উঠে
এসেছেন অভিজাত বিপণিতে।
বিশেষ করে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র
বসুন্ধরা সিটিতে বর্তমান ২৪
জন মালিকের ৩৩টি জ্যোতিষী ফার্ম
রয়েছে। ঠান্ডা
হিমেল হাওয়া এসব বিপণিতে
সাধারণ মানুষ এসে প্রতারণার
শিকার হচ্ছেন। এ
দেশের সাধারণ মানুষের বহুবিদ
সমস্যার সমাধানকল্পে তথাকথিত এসব জ্যোতিষীর কাছে
এসে সহসাই আরও বিপদগ্রস্ত
হচ্ছেন। কারও
সমস্যা বাড়লেই তাদের ইনকাম
বারে। আগে
এসব জ্যোতিষীদের প্রতিদিনের ইনকাম দিয়ে পেট
চালানো কষ্টকর হলেও এখনকার
জ্যোতিষীরা থাকেন আলিশান বাড়িতে। চড়েন
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্র্যান্ডের লেটেস্ট মডেলের গাড়িতে।
কী নেই তাদের? অন্য
লোকের সমস্যা সমাধান করার
নামে অর্জিত টাকায় নিজের
সব সমস্যার সমাধান করছেন।
জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে
ফিরে এলেন হাসান
কবির
তিনিও
অন্যদের মতো সাধারণ মানুষের
সমস্যা দেখলে তাদের পকেট
কাটতেন। এক
বছর বসুন্ধরা সিটির লেবেল-৬-এ তিনি ভাগ্য
বদলানো পাথর ব্যবসায় করেছেন
রীতিমতো। অল্প
সময়ে তার নাম ডাক
বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিন
তার ভাগ্য বদলানো কাস্টমারের
সংখ্যা বাড়তে থাকে।
মানুষ ঠকাতে ঠকাতে হঠাৎ
তার বিবেক জাগ্রত হলে
উপলব্ধি হয় তিনি অন্যায়
করছেন। এরপর
সিদ্ধান্ত নেন তিনি আর
মানুষ ঠকাবেন না।
গত পহেলা বৈশাখ থেকে
তিনি তার ভাগ্য বদলানো
পথর ব্যবসায় বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন
তিনি চেষ্টা করছেন সাধারণ
মানুষ যেন এখান থেকে
প্রতারিত না হয়।
কেউ তার কাছে ভাগ্য
বদলানোর পরামর্শ নিতে এলে তিনি
আগে আগত ব্যক্তির সিদ্ধান্ত
বদলাতে অনুরোধ করছেন।
বিখ্যাত কয়েকজন
প্রতারক জ্যোতিষীর কীর্তি
উদাহরন এক - বসুন্ধরা সিটির ব্লক-এ,
লেভেল-৬-এর ৯টি
বিলাসবহুল দোকান ইজমার মালিক
ভাগ্য বদলানো পাথর ব্যবসায়ী
মঞ্জু উর রহমান।
প্রতিদিন তার দোকানে ৪-৫ লাখ টাকা
বিক্রি হয়। কিন্তু
ভ্যাট-ট্যাক্স কীভাবে দিতে হয়
তা তার জানা না
থাকলেও তিনি বলেন, আমরা
ঠিকমতো ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ
করি। সর্বশেষ
কবে ও কত টাকা
ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়েছেন তা জানতে চাইলে
তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়
শুরুর সময় চার হাজার
টাকা রাজস্ব বোর্ডে জমা
দিয়েছি। মাত্র
এক বছর আগে একটি
দোকান দিয়ে ব্যবসায় শুরু
করলেও বর্তমান বসুন্ধরা সিটিতে তার ৯টি
দোকান। তিনি
পড়াশোনা করেননি বলে নিজের
নামও ঠিকমতো স্বাক্ষর করতে
পারেন না। তিনি
জ্যোতিষশাস্ত্র কোথাও থেকে শেখেননি। তবে
এ পেশায় এসেছেন জ্যোতিষীদের
অনুরোধে। বর্তমান
তার তত্ত্বাবধায়নে ৫ জন জ্যোতিষী
চাকরি করেন। গত
২৬ মে বসুন্ধরা সিটিতে
অবস্থিত তার নিজস্ব কার্যালয়
ইজমাতে গেলে তাকে পাওয়া
যায়নি। পরে
২৭ মে মধ্যরাতে তার
সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়।
তখন তিনি নিজ গাড়িতে
এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন।
অন্য লোকের সব সমস্যার
সমাধান করতে পারলেও তখন
তিনি স্ট্রোকজনিত কারণে চিকিৎসা করাতে
ব্যাংককের দিকে যাচ্ছেন।
আগামী ৬ জুন তার
দেশে ফেরার কথা।
তিনি যাওয়ার সময় এই
প্রতিবেদককে জানান, অনেক জায়গায়
মানুষ পাথর কিনে প্রতারিত
হলেও আমার এখানে কারও
প্রতারিত হওয়ার রেকর্ড নেই।
উদাহরন দুই
- কানাডার নাগরিকত্বের
জন্য আরাফাত নামের এক
ব্যক্তি পত্রিকায় সব মুশকিল আসানের
বিজ্ঞাপন দেখে সাইকি ভবনের
মালিক পীরজাদা, মহাগুরু, জ্যোতিষসম্রাট ড. জীবন চৌধুরীকে
ফোন করেন। সমস্যা
সমাধানের ১০০ পার্সেন্ট নিশ্চয়তা
দেন তিনি। বলেন,
তোর শনি খারাপ।
শনি ভালো করতে পৃথিবীর
৭ মাথায় ৭টি গরু
কোরবানি দিতে হবে।
এ জন্য টাকা লাগবে
৩ লাখ। ৭
দিনের মধ্যে কানাডার নাগরিকত্ব
পেয়ে যাবি। আরাফাত
প্রথমে তাকে তিন লাখ
টাকা দেন। কিন্তু
যথাসময়ে কাজ না হলে
জ্যোতিষী বলেন, বাম হাতে
টাকা দিয়েছিস বলে তোর কাজ
হয়নি। তুই
আবারও ডান হাতে তিন
লাখ টাকা পাঠা।
আবারও টাকা পাঠালে যথাসময়ে
কোন কাজ না হলে
আরাফাত টাকা ফেরত চান। তখন
জীবন বলেন, তুই তিন
দিনের মধ্যে বিষাক্ত সাপের
কামড়ে মারা যাবি।
সে ব্যবস্থা করে রাখলাম।
প্রতারণা বুঝতে পেরে দেশে
চলে আসেন আরাফাত।
তিনি র্যাব ৩-এর কাছে লিখিত
অভিযোগ করেন। এ
অভিযোগে র্যাব জীবন
চৌধুরীকে গ্রেফতার করে ২০০৮ সালের
৩০ জুন। জীবনের
আখড়া সাইকি ভবন থেকে
উদ্ধার করা হয় নানা
ধরনের গোলক, বিভিন্ন রঙের
পাথর, ছদ্মবেশ ধরার কাজে ব্যবহƒত বিশেষ ধরনের
আলখাল্লা, মাদকদ্রব্য। সেই
সঙ্গে জীবন চৌধুরীর ব্যক্তিগত
মোবাইল ফোন থেকে উদ্ধার
করা হয় অর্ধশতাধিক পর্নো
ভিডিও। যেগুলোতে
বিভিন্ন নারীর সঙ্গে যৌনকাজে
লিপ্ত দেখা যায় জীবন
চৌধুরীকে। পরে
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জীবন
স্বীকার করে, যেসব নারীর
বাচ্চা হয় না বা
বন্ধ্যত্বের সমস্যা নিয়ে তার
কাছে আসত তাদের সঙ্গে
যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন তিনি। এতে
অনেকে গর্ভবতী হয়ে যেত।
জীবন চৌধুরীকে সোপর্দ করা হয়
পল্টন থানায়। ১
মাস জেল খেটে জামিনে
বেরিয়ে আসেন। এখন
তিনি আবারও ওই ব্যবসায়
শুরু করেছেন।
উদাহরন তিন
- রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির লেভেল-১,
ব্লক ডি-এর ৭০
ও ৭১ নম্বর দোকান
নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে
আলিশান আস্তানা তৈরি করেছেন লিটন
দেওয়ান চিশতি। নিজেকে
তিনি জ্যোতিষরাজ ও পীরে কামেল
হিসেবে দাবি করেন।
তিনি পাথর বিক্রি করে
কয়েক কোটি টাকার মালিক
বনে গেছেন। চড়েন
পাজেরো গাড়িতে। তার
স্লোগানÑ আর হতাশা নয়
সফলতার জন্য আসুন।
তিনিও একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। লিটন
দেওয়ানের দাবি, যে কোন
মুশকিলের আসান তিনি করে
দিতে পারেন মুহূর্তেই ! এ
জন্য তিনি রাশি গণনা
করে পাথর দেন।
এ ছাড়া মন্ত্রের মাধ্যমে
সমস্যার সমাধান করে থাকেন। তিনি
৯০ সাল থেকে এ
পেশায় আছেন। বংশগতভাবে
তার এ পেশায় আসা। তবে
তিনি নিজেই বলেছেন, তার
শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস।
যে পেশায় তিনি আছেন
সে পেশায় শিক্ষাগত যোগ্যতার
কোন প্রয়োজন নেই। তার
আস্তানায় গেলে দেখা যায়,
অনেক মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে তার
ছবি। অনেকের
কাছ থেকে তিনি পুরস্কার
নিচ্ছেন। তার
দাবি মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু
করে অনেক ভিআইপি তার
ক্লায়েন্ট। তিনি
বলেন, যে কোন মানুষের
মুখ দেখেই আমি তার
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে
দিতে পারব! লিটন দেওয়ানের
সঙ্গে সাক্ষাতের ভিজিট ৫০০ টাকা। তিনি
৫০০ থেকে ৫ লাখ
টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন দামে পাথর বিক্রি
করে থাকেন। কোরআন
ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তার পাথর
বিক্রির ব্যবসায়। পাথরের
ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, নবী
(সা.) আকিক পাথর পরতেন
আর আমরা যখন হজে
যাই তখনও একটি পাথরে
চুম্বন করি। কিন্তু
তার সাথে মুশকিল আসানের
কি সর্ম্পক তা তিনি বলেননী
।।
দৈনিক যুগান্তর
(29/05/12) থেকে – মূল লিখেছেন রিপন
মোহাম্মদউল্লাহ ও এম. মিজানুর
রহমান সোহেল
0 comments:
Post a Comment