Translate

Tuesday, July 23, 2013

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

 আদর্শ নয়, ভোগবাদই এখন রাজনীতির মূলমন্ত্র। শাসক আওয়ামী লীগকে ভোগবাদই কুরে কুরে খাচ্ছে। ৬৪ বছরের পুরনো দলটি এখন জনবিচ্ছিন্ন। যে দলটি বার বার ক্ষমতায় এসেছে নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কোনবারই সে প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারেনি। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সে এক অন্য ইতিহাস। ক্ষমতা আর ভোগবাদ যখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তখন শাসকেরা জনপ্রিয়তা হারায়। আওয়ামী লীগ এর বাইরে নয়। দলনেত্রী যতই পরাজয়ের কারণ খুঁজুন না কেন, তা পাবেন না- যদি নিজের দিকেই না তাকান। সাড়ে চার বছরের আওয়ামী জমানার ভিত নড়ে গেছে পাঁচ সিটিতে নির্বাচনের পর। কোন মেয়র প্রার্থী উন্নয়ন করেছিলেন, কে সৎ- এটা বিবেচনায় কোনকালেই নেন না ভোটাররা। ভোট রঙে ব্যক্তিবিশেষের উন্নয়নমুখী ভাবমূর্তি কোন গুরুত্বই পায় না। ভোটারের রাজনৈতিক আনুগত্য বিশেষ করে দলীয় আনুগত্যই প্রাধান্য পায়। তাছাড়া, সুশাসনের জন্য নাগরিক নির্বাচনের আগে মেয়রদের সহায়-সম্পদের যে বিবরণ প্রকাশ করেছিল তা কি শাসক দল বা নেত্রী কখনও বিবেচনায় নিয়েছেন। পাঁচ বছর আগে একজন মেয়রের কি সম্পদ ছিল আর ক্ষমতা ছাড়ার সময় কত দাঁড়িয়েছে। সঠিক হিসাব না দিলেও অঙ্কটা কিন্তু বিশাল। যা-ই হোক, পরাজয়ের কারণ ধর্ম বা হেফাজত এটা কিন্তু ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মাত্র এক বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে কেন হারলো দলটি? তখন তো হেফাজতের কোন অস্তিত্বই ছিল না। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কি হেফাজত ভূমিকা রেখেছে? নারায়ণগঞ্জ কিংবা রংপুর সিটিতে তো বিদ্রোহী প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের তৃতীয় ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হবিগঞ্জ উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় নিয়ে বিশ্লেষণই করা হয়নি। ২০০৮-এর নির্বাচন দিয়ে কি সবকিছু মূল্যায়ন করা যাবে? ভুলটা সেখানেই। বলাই বাহুল্য, দল আর সরকার এক হয়ে যাওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ দ্রুত জনবিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তত ৬টি ব্যবসায়ী হাউসের (যারা সরকার সমর্থক) জরিপেও সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে তা কিন্তু ফুটে উঠেছে। আন্তর্জাতিক দু’টি সংস্থার জরিপ রিপোর্টেও একই বার্তা এসেছে। তাছাড়া, শেখ হাসিনার তো না বোঝার কারণ নেই। তার জানার বাইরে কিছু আছে কি? গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল অনুকূলে যাবে না- তা তো জানতেন তিনি। দলের নেতা-এমপিরা যদিও তাকে খবর দিয়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার ভোটে শাসক দল জিতে যাবে। এই হিসাবটা তারা কিসের ভিত্তিতে দিয়েছিলেন তা আল্লাহ মালুম। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হচ্ছে বাড়ি কিংবা গাড়ির মতো। এটা যে নিছক এক ব্যক্তিগত সম্পদ। নেত্রী বা নেতার কথাই হচ্ছে প্রতিবাদহীন এক দৈবস্বপ্ন। চাটুকারিতা হচ্ছে সাফল্যের একমাত্র পুঁজি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যদি আমরা তাকাই তখন কি দেখতে পাই। আব্রাহাম লিঙ্কন ছিলেন প্রথম রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। তার মানে এই নয়, রিপাবলিকান দলটি তার আজ্ঞাবহ ছিল। আমাদের দেশে ঠিক তার বিপরীত। পারিবারিক সাম্রাজ্য তো আছেই। স্বৈরাচারের জন্ম হয় এভাবেই। গণভবনে তৃণমূলের বৈঠক করলেই কি দল গোছানো যাবে? দলের সাচ্চা নেতা-কর্মীরা কি চায় তা জানার সুযোগ কোথায়? তৃণমূলের নেতারা কোন সাহসে কথা বলতে যাবেন? যাদের বিরুদ্ধে বলবেন তারা তো প্রথম সারিতেই বসা থাকেন। ফলে দল কখনও কর্মীদের মনে কি আছে জানতে পারবে না বা পারে না। স্বীকার করতেই হবে দলগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। দলে রাজতন্ত্র উজ্জ্বল মহিমায় ভাস্বর। কখনও কখনও পরাজয় ভাল, মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠার চেয়ে। এ থেকে শিক্ষা নেয়া যায়। যদিও শাসকেরা সেটা নিতে চান না। ’৭৩-এর নির্বাচনে কি ঘটেছে বা কিভাবে সামাল দেয়া গেছে তা যদি পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু মূল্যায়ন করতেন তাহলে হয়তো বা বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো যেতো। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের অন্তত ৬১ জন এমপি রয়েছেন যারা ভোটারদের কাছে সরাসরি যেতে পারেন না। একটি অনুগত শাসক গ্রুপ এবং পুলিশ তাদের এলাকায় নিয়ে যায় পাহারা দিয়ে। এর কারণ দু’টো। এক দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোন মূল্যায়ন না করা। দুই. এলাকায় উন্নয়নের বদলে লুটের উৎসব করা। যে উৎসবে এমপি’র পছন্দসই লোকেরাই যোগ দিয়েছে। উল্লাসের নৃত্য করেছে। কেউ স্বীকার করুন আর না করুন ৪২ বছরে এমন লুট আর কখনও হয়নি। আগে লুট ছিল কিছুটা রেখে ঢেকে। এখন খোলাসা। দুর্নীতির হোতা দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট দেয়ায় ক্ষুদে হোতারা দারুণভাবে উৎসাহিত হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামেও দুর্নীতি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। টেন্ডার দখলের যে লড়াই এবার জাতি প্রত্যক্ষ করলো তা আগে কখনও হয়নি।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টেন্ডার না খুলেই টেবিলে ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে। যে কারণে কাঙিক্ষত উন্নয়ন হয়নি। ঢাকা শহরে কয়েকটি ফ্লাইওভার উন্নয়নের একমাত্র দৃষ্টান্ত হয় কিভাবে? ব্যাংকের টাকা লুটের যে নজির স্থাপন করা হয়েছে তা কি আগে এভাবে কখনও হয়েছে? বিদ্যুতের উন্নতি কে না চায়। তাই বলে জনগণের ওপর অযৌক্তিক করের বোঝা বাড়িয়ে স্বস্তি নিশ্চয়ই কেউ চান না। এভাবে ঢালাও ইনডেমনিটি দেয়ার পরিণতি পাকিস্তানের দিকে তাকালেই জানা যায়। ‘বদল চাই’ ছিল নজরকাড়া স্লোগান। বাস্তবে দেখা গেল বদল নয়, বদলা চাই। ক্ষমতায় এসেই খালেদাকে বাড়িছাড়া করতে হবে। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসকে এক হাত নিতে হবে। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পাল্টাতে হবে- এটা যেন ছিল প্রথম অগ্রাধিকার। বিরোধী নেতা-কর্মীদের ডাণ্ডাবেরি পরানোর মধ্যে কি আনন্দ ছিল? একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের অফিসে ঢুকে পুলিশ যখন শাবল দিয়ে তালা ভাঙে আর সে দৃশ্য যখন দেশবাসী টিভির বদৌলতে সরাসরি দেখতে পান তখন কি প্রতিক্রিয়া হয় বা হবে তা তো শাসক দল ভেবে দেখেনি। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম আওয়ামী লীগের সাড়ে চার বছরের শাসনকে মাত্র তিন শব্দে বর্ণনা করেছেন- দাম্ভিকতা, খামখেয়াল আর প্রতিহিংসা। বাস্তব অবস্থা তো তাই। যেভাবে বিরোধী মতকে দমন করার চেষ্টা হয়েছে তাতে সচেতন নাগরিকদের সামনে বিকল্প কি? বর্তমানকে অস্বীকার করে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা যায় না। শুধু স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হওয়া যায়। তাছাড়া, শাসক যদি ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে মান্যতা না দেয়, উল্টো যদি নির্যাতনের পথ বেছে নেয় তখন বিপদ অনিবার্য।
অমিত রহমান: শুক্রবার, ১৯ জুলাই ২০১৩  Daily Manbab Jameen

0 comments:

Post a Comment